by Suhrid Chatterjee
সৈকত সান্যাল এক অতি সাধারন মানুষ। দশটা পাঁচটার চাকরি করে। বিয়ে করেছিল কিন্তু বৌ ছেড়ে চলে গেছে। না ঠিক ডিভোর্স হয়নি। কিছু দিন চুপ করে ছিল তারপর ভেবে দেখলো ভালোই হয়েছে। ল্যাটা চুকে গেছে। খোঁজও করেনি আর বিয়েও করেনি। তার জীবনে কোনো তাপ উত্তাপ নেই। ভাগের শরিকি বাড়িতে থাকে। রোজ নিজেই রান্না করে খায়। অফিস করে । জীবনে আর কি চাই । ওঁর একটা মস্ত বড়ো গুণ আছে সে কোনো কিছুতে অবাক হয় না।
যে লোকটার এতো দিনের চাকরি, কোনো দিন এক মিনিট লেট হয় নি সেই মানুষটি কিনা পর পর তিন সপ্তা লেট। ভাবা যায়। নেহাত অফিসের বড়ো বাবু লোকটি ভালো। এক দিন তাকে ডেকে বললে “সান্যাল ভায়া কি হয়েছে বলতো ইদানিং তোমাকে কেমন একটা লাগছে। রেগুলার লেট হচ্ছে। আমাকেও তো জবাব দিতে হয়। ভালো ডাক্তার দেখাও দিকিনি কিংবা একটা লম্বা ছুটি নিয়ে কোথাও ঘুরে এসো।”
সৈকত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে মাথা নাড়লো।
সে কি করে বোঝায় তার রাতের ঘুম গ্যাছে খাওয়ায় রুচি নেই কোনো কাজ ঠিক মতন করতে পারছে না। শুধু একটাই চিন্তা কি জানি কি হবে। ভাবলেই বুকটা হু হু করে ওঠে। কপাল ঠুকে বলে সব ঠিক আছে।
ঠিক আছে পুরো ব্যাপারটা শুরু থেকে খোলসা করে বলি।
সৈকতের ঠাকুরদা স্বর্গীয় বরোদা চরণ সান্যাল ছিলেন এক সাহেবের খাজাঞ্চি। সেই সময় সাহেবের সাথে হিসাবে গরমিল করে বেশ খানিক টাকা বানান এবং সেই দিয়ে এক খানি বাড়ি বানান দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর অঞ্চলে। এক দিন চুরির দায় সাহেব ধরা পড়েন সঙ্গে নিয়ে ডোবান বরোদা চরণ কেও। জেল হয়। কপাল ভালো তার বছর কয়েক পরে দেশ স্বাধীন হয় এবং তিনি ছাড়া পান। সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামীর তকমা ও মাসে মাসে পেনশন। কপাল আর কি। সেই বরোদা চরণের তিন ছেলে। বড়ো দুর্গাচরণ, মেজো কালীচরণ আর সবার ছোট দক্ষিনাচরণ। যথাসময়ে বোরোদাচরণের গঙ্গা প্রাপ্তি হয় তারপর বাড়ি নিয়ে ভাইদের মধ্যে বচসা শুরু হয়। তার কিছু বছর পর বাড়ি ভাগ হয়। নিচের তলার কোনার দুটি ঘর পড়ে দক্ষিণাচরণের কপালে। লাগোয়া অবশ্য এক ফালি চাতাল ছিল সেটা বানানো হলো স্নানের ঘর আর রান্নার ঘর। বাকি জায়গায় ওঠে পাঁচিল। ভাইদের মধ্যে মুখ দেখা দেখি বন্ধ।
এক বিদেশী মদের কোম্পানির একাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন দক্ষিনা। স্বামী স্ত্রী আর ছোট্ট সৈকত কে নিয়ে চললো দৈনন্দীন জীবন যাপন। আস্তে আস্থে ছোট্ট সৈকত বড়ো হতে লাগলো। স্কুল পেরিয়ে কলেজ। সব ঠিক চলছিল। যেদিন সৈকত বি কম পাস করলো সেদিন দক্ষিনাচরণ বেজায় খুশি হলেন। সেদিন রাতে হোটেল থেকে প্রচুর খাবার এলো বিস্তর খাওয়া হলো অনেক রাত অবধি গল্প হলো। ভোর বেলায় টান উঠলো ডাক্তার ডাকতে ডাকতে দক্ষিণাচরণ বৈতরণী পার করলেন সৈকত পিতৃহারা হলো। বাবার চাকরি ছেলে পেলো। কিছুদিন যাবার পর মা বায়না ধরলো “বাবা এবার একটা বিয়ে কর, কত দিন আর আমি তোকে রান্না করে খাওয়াবো” সৈকত নিমরাজি হলো বটে কিন্তুটা রয়ে গেলো। একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখলো মায়ের উদুম জ্বর। নুসু মানে নিশিকান্ত ডাক্তার এসে দেখে গেলো কিন্তু ওষুধ কাজ দিলো না। সৈকত মাকে হাসপাতালে ভর্তি করলো। সাত দিন পর মাকে আর বাড়ি আনলো না। সোজা নিয়ে গেলো শশানে। শেষ কৃত্য করে বাড়ি ফিরলো। হটাৎ সে একা হয়ে গেলো বাড়িটা কেমন খালি হয়ে গেলো।
সৈকত ঘরের কাজ করতে লাগলো। সকাল সকাল উঠে ঘর ঝড় দেয় রান্না করে খেয়ে টিফিন নিয়ে অফিস যায়। রান্না করা তার নতুন নেশা। হোটেল থেকে ভালো ভালো খাবার দেখে এসে কম্পিউটার ঘেটে তার রেসিপি বার করে রান্না করে নিজে খেত আর অফিসে বাকীদের খাওয়াতো। বছর খানেক এই রকম চললো তারপর তার মায়ের কামনা বন্ধুরা পুরো করলো। চপলদা তার এক দূর সম্পর্কের বোনের মালতীর সাথে বিয়ে ঠিক করলো। সৈকত ও রাজি হয়ে গেলো। অফিসের বন্ধু রাই সব করলো কারণ তার তো আর কেউ নেই। সে অবশ্য গিয়ে ছিল জ্যাঠাদের বলতে কিন্তু তারা কেউ তাকে পাত্তা দেয় নি। তারাও অবশ্য তাদের ছেলে পুলের বিয়েতেও ওকে ডাকেনি। শুধু বড়দা মানে বড়ো জ্যাঠার বড়ো ছেলে তাকে বলে ছিল একবার দেখা করিস তো দরকার আছে। তালে গোলে সেও ভুলে গেলো। বিয়ে করে একটা ফুট ফুটে বৌ ঘরে আনল।
সংসার করলো বটে সৈকত, বলতে হবে। সে রান্না করতে ভালোবাসত যে। তাই সকাল সকাল উঠে চা করে দিতো। ফাটাফাটি জলখাবার বানাতো। দুপুরের খাবার বিনিয়ে বৌয়ের জন্য রেখে নিজের টিফিন বাক্স ভোরে নিয়ে যেত। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে রাতের রান্না করে দুজনে মিলে খেত। ছুটির দিন ঘর ঝাড় পোচ করা কাপড় কাচা কত কাজ। সে বেজায় খুশি হৈ হৈ করে দিন কাটাতে লাগলো। আর মালতি সেও কিন্তু বেজায় খুশি ছিল। সারা দিন টিভি দেখতো, কার সঙ্গে ফোনে গল্প করতো আর সেই ফোনেই গেম খেলতো। বাপ মা মরা মেয়ে মাসির কাছে মানুষ। ঠিক করে দু বেলা খেতে দিতো না আর প্রচুর কাজ করতো। তার কাছে তো এটা সর্গ। খাচ্ছ দাচ্ছে আর ঘুমোচ্ছে। তবে কথায় আছে না বেশি দিন সুখ সয় না। তাই হলো।
বেশ কিছুদিন ধরে সে লক্ষ করলো যে তার বাড়িতে হটাৎ পাড়ার ছেলেদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। যার বাড়ি কেউ কোনোদিন আসতো না তার বাড়িতে এতো লোক, কি জন্য। সে কোনোদিন কোনো কিছুতে অবাক হন না। তাই বুঝেও বুঝলো না। একদিন মালতি বললো সিনেমা দেখতে যাবে অমুক বৌদির সাথে। সে মাথা নেড়ে সায় দিলো আর কিছু টাকাও দিলো। এর পর থেকে প্রায়শই বোসে বৌদি বা গোষ গিন্নির সাথে সিনেমা দেখা বেড়ে গেলো। শুরুতে সৈকত ফেরার আগেই মালতি বাড়ি চলে আসতো কিন্তু ধীরে ধীরে সন্ধে হলো তারপর একটু রাত হলো আর সাহস বাড়লো। শুরুতে সপ্তাহে এক দিন তারপর দুই দিন তারপর প্রায় রোজ। অফিস থেকে খালি বাড়িতে ফিরে রান্না করে মালতির জন্য অপেক্ষা করতো। সৈকত কোনোদিন কোনো কিছুতেই অবাক হন না।
রোজকার মতন এক দিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখলো মালতি নেই। সে রান্না শেষ করে চান করে টিভি চালিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। যখণ খিদে পেলো একটু খেয়ে নিয়ে দরজার দিকে চেয়ে বসে রইলো। হটাৎ দর্জা খুলে মালতি এসে তার সামনে দাঁড়ালো। সৈকত খুশিতে লাফিয়ে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরলো। তখন সে লক্ষ করলো তার পেছনে পাড়ার সব ছেলে গুলো দাঁড়িয়ে আছে। ফিরে দেখলো তার মা পাশে দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসছেন। কারণ জিজ্ঞেস করতে যাবে তো দেখলো যে মালতি আসতে আসতে পিছিয়ে যাচ্ছে। সে ধরবার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। এক পা এগোতেই ধড়াম করে পড়ে গেলো। ঘুম ভাঙলো বুঝলো মাটিতে পড়ে তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। উপরে তাকাতেই দেখলো যে মা তখনো ছবির মধ্যে মিটি মিটি হেসে চলেছে।
মালতি আর বাড়ি ফেরেনি। সৈকত পরে বুঝতে পারলো যে সে তার সব গয়না, জামা কাপড় এবং বিয়েতে পাওয়া স্কাই ব্যাগ সুটকেস নিয়ে গেছে। সে এই কথা কাকে বলবে তাই চুপ করে রইলো। সে আবার তার দৈনন্দিন জীবনে ফিরে গেলো। খালি দুজনের জাগায় একজনের জন্য রান্না করতো। বেশ কিছুদিন পর ব্যাপারটা অফিসে জানাযানি হলো। কানাঘুষো চললো তারপর যে যার কাজে লেগে পড়লো। আর সৈকত, সে তার পুরোনো জীবন নিয়ে বেশ আনন্দতেই রইলো।
এক দিন অফিস থেকে ফেরার সময় রাস্তায় প্রচুর জ্যাম পড়ল। তার বাস আর এগোয় না। প্রায় কুড়ি মিনিট চুপ করে বসে থেকে আর পারলো না। বাস থেকে নেবে সৈকত বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। বেশি না তিনটে মাত্র স্টপ তারপর তার বাড়ি। সবে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে তাই হাটতে বেশ ভালোই লাগছিলো। রাস্তার ধারে দোকান দেখতে দেখতে এগিয়ে চললো। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে একটু কিছু নেড়ে চড়ে দেখলো। তারই মধ্যে দেখল একটা দোকান যেখানে পুরানো জিনিষের সলে চলছে। অল্প কিছু মাল নিয়ে এক বৃদ্ধ বসে। একটা মজার জিনিস তার চোখে পড়লো। একটু দরদাম করে কিনে নিলো আর বাড়িতে তার খাটের পাশে টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখলো। রাতে শোবার সময় সেটাকে ভালো করে দেখলো। একটা সুন্দর দেখতে বাক্স তার পেছনে একটা চাবি কাঠি। চাবি টায় প্যাঁচ দিয়ে ডালাটা খুললে টুং টাং শব্দ হয় আর একটা পুতুল বেরিয়ে এসে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে। সে এইরকম বাক্স পুরোনো সিনেমায় দেখেছে। তার খুব মজার লগত আর সেটা কিনতে পেরে বেশ খুশি খুশি লাগছিলো। অনেক রাত অবধি ওটা নিয়ে খেলা করলো নাচ দেখলো। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না। ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে ঘড়ি দেখলো। জীবনে প্রথম বার সে অফিসে লেট হলো।
সৈকত চুপচাপ নিজের যায়গায় বসে কাজ করছিলো এমন সময় বড়ো বাবু ডেকে পাঠালো। পাখার তলায় বসেও দর দর করে ঘামতে লাগিল। পাঁচ মিনিট লেট তার জন্য ডেকে পাঠাল আর অরুন নির্মল রা তো রোজ লেট করে ওদের তো ডাকা হয় না। প্রচন্ড ভয় পেয়ে কাচুমাচু করে তার সামনে দাঁড়িয়ে নামতা পড়ার মতন করে বলতে লাগলো
“স্যার ভুল হয়ে গেছে আজ সকালে উঠতে দেরি হয়েছে কাল রাতে ঘুম আসছিল না তাই দেরি …… । বড়ো বাবু তার দিকে তাকিয়ে বললো “কি বলছো বুজতে পারছি না যাও ওয়েলিংটন এর ফাইল টা নিয়ে এস।
“আঃ ওঃ” বলে টুক করে ফাইলটা দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
দুপুরে খাবার সময় সবাই লক্ষ্য করলো ব্যাপারটা।
তরুণ জিজ্ঞেস করলো “ও সান্যাল আজ লাঞ্চে কি এনেছো”
বড় লজ্জায় সে বললো “আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল অফিসে লেট হয়ে যাবে বলে রান্না করি নি।
“আরে দূর মশাই, আমি রেগুলার লেট হৈ ছাড়ো তো আজ বরং চলো আমাদের সঙ্গে নিচে খাবে চলো” সে এক আজব দুনিয়া। কত রকম খাবার। ভাত চচড়ি থেকে শুরু করে বিরিয়ানি। নতুন পাক থেকে লেডিকেনি সব পাওয়া যায় কিন্তু ভালো রান্না জানলে যা হয়। কোনোটায় রসুন বেশি তো কোনোটায় আদা কম তাই কোনোটায় জায়ফল দিলে ভালো হতো। খাওয়া শেষে সবাই বললো
“ভায়া কাল থেকে ঘড়িতে দম দিয়ে শুও যাতে সময় মতো রান্না করতে পারো” কেন বুঝতে পারলো না তবুও মাথা হেলিয়ে শায় দিলো।
সেই রাতে সৈকত খেয়ে দেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো। তার নতুন খেলনাটা নিয়ে দুই একবার নাড়াচাড়া করে ডালা বন্ধো গুমিয়ে পড়লো। মাঝ রাতে ঘুম চোখে দেখলো ডালাটা খোলা আর টুং টাং শব্দ করে পুতুলটা নেচে চলেছে। কোনোমতে হাত বাড়িয়ে সেটা বন্ধ করে আবার গুমিয়ে পড়লো। সকাল বেলায় ব্যাপারটা ভুলেও গেলো। কিন্তু যখন পর পর তিন রাত্রি একই ভাবে ডালা খুলে পুতুলটা নাচলো তখন তার চিন্তা হলো আখিরে হচ্ছেটা কি। ছুটির দিন সকালে বাক্সটা নিয়ে বসলো। ভাবলো একবার খুলে ভেতরটা দেখবে কিন্তু সে টেকনিক্যালি চ্যালেঞ্জড ভয় হলো যদি খারাপ হয়ে যায়। এখনো সে টুবলাইট বালব পাল্টাতে ভয় পায়। সে বাক্সটা টেবিলের উপর রেখে তাকিয়ে রইলো কিছুই হলো না। সারাদিন একটা টুঁ শব্দ করলো না। রাতে বাক্সটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ল আর ঠিক মাঝ রাতে পুতুলটা টুং টাং করে নাচতে লাগলো। সে অনেক রাত জেগে থাকার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না আর গুমিয়ে পড়লেই ঠিক মাঝ রাতে বাক্সটার ডালা খুলে পুতুলটা নাচতে লাগতো। এক রাতে যেই ডালা খুলে টুং টাং শুরু হয়েছে ওমনি বিরক্ত হয়ে সে ডালা বন্ধ করে দিলে।সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা তাকে ঘিরে ধরে আর দূরে কোথাও কারুর ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। তাড়াতাড়ি ডালাটি খুলে দিতেই সুন্দর শুরে ঘর ভোরে ওঠে। নাচ শেষ হওয়ার পর যখন সৈকত ডালাটি বন্ধ করে সে কিন্তু সেই কান্নার আওয়াজ আর পায়নি। সৈকত অনেক প্রয়াস করলো। ভাবলো বাক্সটা ছুড়ে ফেলে দেবে চেষ্টাও করলো কিন্তু পারলোনা। শখের জিনিস ফেলতে পারলোনা। তাকের উপর তুলে রাখলো কিন্তু মাঝ রাতে উঠে বাক্সটা নাবিয়ে ডালা বন্ধ করতে হলো। দম দেওয়া বন্ধ করলো তবুও ঠিক মাঝ রাতে ডালা খুলে পুতুলটা ধেই ধেই করে নাচে। তিন সপ্তাহ হয়ে গেলো রোজ রাতে নাচ না দেখা অবধি ঘুমাতে পারে না। সে কি করে বোঝায় তার রাতের ঘুম গ্যাছে খাওয়ায় রুচি নেই কোনো কাজ ঠিক মতন করতে পারছে না। শুধু একটাই চিন্তা কি জানি কি হবে। ভাবলেই বুকটা হু হু করে ওঠে। কপাল ঠুকে বলে সব ঠিক আছে।
সৈকত সেই দোকানে গিয়ে খোঁজ করলো। দোকানদার ওই বৃদ্ধকে কোণে একটু জায়গা দিয়েছিলো তার মালপত্র নিয়ে বসার জন্য তবে কিছু দিন হলো সেই বৃদ্ধ নাকি তার পাট্রা নিয়ে আসা বন্ধ করেছে। কেউ তার ঠিকানা বিশেষ বলতে পারলো না। অফিসেও কারুর সাথে ব্যাপারটা আলোচনা করতে পারলো না। যদি তারা হাসা হাসি করে। তাই দিন শেষে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সোজা গেলো কালীঘাট ভাবলো যদি কোনো গণৎকার পাওয়া যায়। দুই একজনের সঙ্গে কোথাও বললো তবে বিশেষ ফল হলো না। পরের দিন ছুটি নিয়ে এদিক ওদিক খোজ খুঁজি করলো। কোনো লাভ হলো না। মনমরা হয়ে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের কাছে মা কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে এক বোতল জল কিনে খেতে যাবে এমন সময় ছিপিটা হাত ফস্কে রাস্তায় পড়ে গড়িয়ে গেলো। সেটা তুলে ডাস্টবিনে যখন ফেলতে যাবে তখন সাইনবোর্ডটা চোখে পড়লো। “প্রেমলিনা সার্ভিসেস” ‘এখানে আপনার সকল প্রকার সমস্যার সমাধান করা হয়’ ‘স্থাহি প্রতিকারের জন্য যোগাযোগ করুন’ সঙ্গে টেলিফোন নম্বর। একটা তীর চিহ্ন বা পথ নির্দেশক ছিল। সে খানিক্ষণ চেয়ে পা বাড়ালো।
এক ফালি সরু সিঁড়ি বেয়ে, আজীবনকাল রং না করা পানের পিক ভরা দেওয়াল বাঁচিয়ে উপরে উঠে গেলো সৈকত। একদম শেষের ঘরটা “প্রেমলিনা সার্ভিসেস” এর অফিস। পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকলো। ছোট্ট এক চিলতে ঘর। একটা পুরানো আমলের আলমারি তার উপর টাসা রদ্দি কাগজ। এটিকে বিশাল বড়ো মা কালির ছবি তাতে প্রচুর সিঁদুর লাগানো আর মালা চড়ানো। ধূপের সুগন্ধে ঘর মঃ মঃ করছে। সামনে একটা আদ্যিকালের টেবিল সেখানে এক মধ্য বয়সী মহিলা সোয়েটার বুনছে। সামনে দাঁড়িয়ে সৈকত একটু গলা ঝাড়লো। মহিলা চোখ তুলে তাকে দেখিই এক গাল হাসি নিয়ে সোজা হয়ে বসলো।
“অরে দাঁড়িয়ে কেন বসুন বসুন” বলে সামনের চাইরটা দেখালো।
হাত জোড় করে মহিলা বললো “প্রেমলিনা সার্ভিসেস এ আপনাকে স্বাগত, বলুন কি সমস্যা আপনার” ভাব দেখে বুঝলো বেশ কিছুদিন পরে খদ্দের এসেছে তবুও সে সংক্ষেপে পুরো ঘটনাটা বললো। মহিলা তার কথা মনোযোগ সহকারে শুনলো। “হুঁ” বলে একটু গম্ভীর ভাবে তার দিকে চেয়ে উঠে দাঁড়ালো। এক মিনিট বলে গিয়ে আলমারি খুলে কি যানি খুঁজলেন। একটা ফাইল বার করে আবার এসে বসলেন। ফাইল থেকে একটা ছবি বার করে তার সামনে রেখে জিজ্ঞেস করলেন “আপনি কি এই বাক্সটার কথা বলছেন। সৈকত গোল গোল চোখ করে ছবিটা দেখলো।
“হ্যা এটাই সেই বাক্স। হুবহু এক” বলে প্রায় লাফিয়ে উঠলো।
মহিলা আবার জিজ্ঞেস করলেন “ঠিক বলছেন তো”
সৈকত মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
“এই নিয়ে এই বছরে দু বার”
“মানে আমার আগেও” …..।
“হ্যা কিছু মাস আগে এক ভদ্রলোক এই বক্সের সমস্যা নিয়ে আসে”
“তারপর?”
“আমরা তার সমস্যার সমাধান করে দিয়েছি, এখন তারা সুখে জীবন যাপন করছেন”
“ও তার মানে আমার ও সব ঠিক হয়ে যাবে”
“নিশ্চই, কোনো চিন্তা করবেন না”
সৈকত চোখ তুলে মা কালির ছবির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো “শেষে তুমি আমায় পথ দেখলে মা”
“আচ্ছা এবার বলুন আমায় কি করতে হবে আর কত খরচ হবে” সৈকতের গলায় এবার জোর এসেছে। “তা আমাদের প্রতিনিধি আপনাকে সব বুঝিয়ে দেবে, আপনি শুধু আপনার ফোন নম্বর আর নাম লিখে দিয়ে যান বাকি আমরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবো”
“আজকে আপনাকে কত দেব”
“একশো টাকা, কন্সালটেশন ফিস”
সৈকত একশো টাকা দিলো আর ভদ্রমহিলা সেটার রসিদ কেটে জমা নিলো।
“এখন আমার কি করণীয়”
“কিছু করবেন না, যা করার আমরাই করবো”
“জিনিষটা আবার আজ রাতে জালাবে তো”
“এতো দিন সহ্য করলেন আর দুটো দিন কষ্ট করে মানিয়ে নিন, আমরা তো কেসটা নিলাম”
“ওহ আশ্বাস দিচ্ছেন তাহলে”
“শান্তি মনে বাড়ি যান সব ঠিক হয়ে যাবে”
সেই রাতেও ডালা খুলে পুতুলটা টুং টাং করে নাচলো আর সৈকত তার দিকে তাকিয়ে বললো “তোমার ব্যবস্থা করে এসেছি পুতুল রানী এবার যত খুশি নেচে নাও” দুর থেকে একটা খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ ভেসে এলো, সৈকত শুনেও না সোনার ভান করে পাস ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো।
দুটো দিন বড় চিন্তায় কাটালো সৈকত। ফোনের দিকে তাকিয়ে সব কাজ করলো। কিছু কল এলো বটে কিন্তু সব বাজে। ক্রেডিট কার্ড, লোন, হলিডে প্যাকেজ সবাই ফোন করলো শুধু যাকে দরকার সে ছাড়া। সে মন দিয়ে কাজ করছিলো যখন ফোনটা এলো। আবার ব্যাঙ্ক থেকে ভেবে ব্যাজার ভাবে হ্যালো বললো। উল্টো দিক থেকে এক মধুর গলা ভেসে এলো “হ্যালো, নমস্কার, আমি প্রেমলিনা সার্ভিসেস থেকে বলছিলাম”
চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠে বললো “হ্যা হ্যা বলুন বলুন আমি আপনার কালের জন্য অপেক্ষা করছিলাম”
উল্টো দিক থেকে একটা হালকা হাসি শুনতে পেলো। সে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বারান্দায় চলে গেলো। বাকি সবাই নিজেদের মধ্যে চাওয়া চায়ী করলো। প্রথম বার সৈকত কে এতো উত্তেজিত হতে দেখলো।
“হ্যা এবার বলুন আমাকে কি করতে হবে”
“নিশ্চয় বলবো। কিন্তু তার আগে আমি পুরো ব্যাপারটা জানতে চাই”
“ঠিক আছে অরে হলো কি। ….”
“আচ্ছা আচ্ছা ফোনে এই সব কথা বলা ঠিক হবে না আর আমি নোট করতে পারবো না, তাই বলি কি কোথাও দেখা করা গেলে ভালো হতো”
“কোথায় বলুন”
“আমি আপনার অফিসে আসতে পারি কিংবা আপনার বাড়িতে”
“না না অফিসে হবে না, আমার বাড়িতেও অসুবিধা আছে”
“তবে আপনি আমাদের অফিসে আসতে পারেন অথবা বাইরে কোথাও”
“বাইরে ঠিক হবে”
“ঠিক আছে এস্প্লানেডে রিগাল সিনেমার কাছে একটা সিসিডি আছে, সেখানে?”
“পারফেক্ট, কটায়”
“আপনি বলুন” “বিকেল সাড়ে পাঁচটায়?”
“এক্সসেলান্ট তাহলে ওই কথাই রইলো, ধর্মতলায় সিসিডি বিকেল সাড়ে পাঁচটায়”.
ডালহৌসি থেকে ধর্মতলা সিসিডি পাক্কা পঁচিশ মিনিটে হেঁটে পৌঁছে গেলো সৈকত। পাঁচ মিনিট বাইরে কাটিয়ে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় ভেতরে ঢুকলো। দাঁড়িয়ে একটু এদিক ওদিক দেখে নিলো। একটা হালকা ভিড় ছিল তাই পেছনের দিকে দুজনের মতন জায়গা পেলো। শীতকালে তার কফি ভালোই লাগে যদিও সে চা প্রেফার করে। পাঁচ মিনিট হয়ে গেলো মেয়েটির দেখা নেই। ভাবলো একটা ফোন করবে কিন্তু থাক আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করে তারপর দেখবে। একটি মেয়ে এলো, জিন্স পরা, খোলা চুল, বেশ সুন্দর দেখতে, ‘হাই’ বলে হাত নেড়ে পেছনে চলে গেলো। তারপর একটা কাপেল এলো, নিজেদের জায়গা খুঁজে বসে পড়লো। পনেরো মিনিট হয়ে গেলো এবার একটা কল করা উচিত ভেবে ফোনটা দেখছিলো যখন সামনে কেউ দাঁড়ালো।
“আপনি নিশ্চই সৈকত বাবু?”
“হ্যা” বলে সৈকত চোখ তুলে দেখে নেহাতই সাধারণ দেখতে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। কাঁধে ঝোলা, হাতে কিছু বই, বিনুনি করা চুল, চাপা শাড়ী গায়ে, ঠিক আছে টাইপ। শুধু পারফিউমটা অসাধারণ, বেশ একটা মায়াবী ব্যাপার আর কি।
“নমস্কার আমি প্রেমলিনা সার্ভিসেস থেকে আসছি, এই আমার কার্ড”
সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বললো “বসুন” কার্ডটা ভালো করে দেখলো সাগরিকা রায়, কনসালটেন্ট। “সরি আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো, সল্ট লেক থেকে এই সময় ট্যাক্সি পাওয়া যে কি কষ্ট”
“ওহ আপনি সল্ট লেক থেকে আসছেন?”
“হ্যা ওখানে এক ক্লিয়েন্টের সাথে মিটিং ছিল”
“ওহ, ওখানে কেসটা কি?”
“আমার ক্লায়েন্টকে নিয়ে আলোচনা করতে চাই না, পেশাদারী ভদ্রতা আর কি”
“ওহ নিশ্চই নিশ্চই”
“মিস রায় আপনি কফি নেবেন তো”
“মিস রায় না আপনি আমাকে সাগরিকা বলে ডাকবেন”
“ওহ আচ্ছা”
“না কফি না আমি একটা Crunchy Frappe নেবো, আপনি?” সৈকত আমতা আমতা করছে দেখে “আপনি বরঞ্চ একটা Cappuccino নিন”
“ঠিক আছে” বলে অর্ডার দিয়ে দিলো।
“এবার বলুন পুরো ঘটনাটা, যতটা পারবেন বিস্তারিত ভাবে মনে করে করে বলুন, কোনো কথা লুকাবেন না”
নিপাট ভালো মানুষের মতন যতটা পারলো খুঁটি নাটি ভেবে ভেবে বললো। সাগরিকা তার নেটবুক এ সব নোট করে নিলো। পুরোটা দেখে যা প্রশ্ন করার করে ব্যাপারটা বুঝে নিলো।
“আপনার অফিস থেকে বললে যে এইরকম একটা ঘটনা আপনারা সমাধান করেছেন”
“হ্যা, সেটা আবার একটা ছোট্ট মেয়ের ছিল, তার বাবা মা প্রচন্ড ভয় পেয়েছিল, আপনি তো অনেক শক্ত দেখছি”
বীরপুরুষের একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো “আচ্ছা ওই বাক্সটার কি হলো”
“জানি না, ঘটনার কিছুদিন পরে ওনারা অস্ট্রেলিয়া চলে যান, আর বদলির সময় ওই বাক্সটা খোয়া যায়” “ওহ এটা সেই বাক্সটা নয়তো?”
“না দেখলে বলতে পারবো না, আমাকে একবার বাক্সটা দেখতে হবে, একবার ওটা নিয়ে আসবেন?” “ঐখানে মুশকিল আছে, আমি ওটা অফিসে নিয়ে যেতে পারবো না আর ওটাকে হাত ছাড়া করতে পারবো না”
“ঠিক আছে, আমার একটা বিয়ের নেমন্তন্ন আছে, এক সপ্তাহের জন্য বাইরে যেতে হবে, ফিরে এসে আপনার ওখানে গিয়ে দেখে এসব”
“তা এখন আমি কি করবো?”
“আরে আপনি তো ভীষণ শক্ত লোক মশাই, ওই রকম একটা জিনিস নিয়ে রাত কাটান, কিচ্ছু হবে না, ঠাকুরের নাম করে শুয়ে থাকুন, সব ঠিক হয়ে যাবে, পরে নিজেই হাসবেন এই সব ভেবে”
“আর আপনার পরিশ্রমিক”
“চেয়ে নেবো, পরিশ্রমটা তো করি, যথা সময় ন্যায্য মূল্য চেয়ে নেবো”
কোনো মোতে সে এক সপ্তা কাটালো। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তো আর দম বন্ধ করে আওয়াজ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতো। সারাক্ষন খালি বলতো আর কয়েকটা দিন তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। থাকতে না পেরে একদিন সে সাগরিকাকে ফোন করলো কিন্তু সেটা নট রিচেবল হলো। বোধহয় বিয়ের কাজে ব্যস্ত ছিল। বুধবার থেকে মঙ্গোলবার তাই পরের দিন ব্যাকুল হয়ে ফোনের দিকে চেয়ে রইলো। এগারোটা নাগাদ কলটা এলো। “হ্যালো সৈকত বাবু কেমন আছেন”
“ভালো নেই বলাই বাহুল্য, আপনার বিয়ে বাড়ি কেমন কাটলো”
“খুব ভালো খুব আনন্দ করেছি”
“একবার দেখা করা যাবে” প্রায় নির্লজ্জর মতন জিজ্ঞেস করলো
“নিশ্চই সেই জন্যই তো ফোন করেছি, আমি দুটোর পর ফ্রি, আসতে পারবেন?”
“দুটোয়? দেখি এক মিনিট” ফোনটি চেপে এদিক ওদিক তাকালো। পাশে থেকে তরুণ বললো “অরে যাও ভায়া আমরা সব সামলে নেবো” তাড়াতাড়ি ফোনটা কানে নিয়ে কন্ফার্ম করলো।
ঠিক দুটো পঁচিশ মিনিটে সে সিসিডির সামনে এসে দাঁড়ালো। এদিক ওদিক দেখে ঢুকে পড়লো। সাগরিকা তখনো আসেনি। নিযেই একটা জায়গা দেখে দরজার দিকে মুখ করে বসে পড়লো। পেছনে কিছু কলেজের ছেলেপুলে হইচই করছিল। সৈকত ঘুরে তাদের দেখলো ওদের মধ্যে একজনের জন্মদিন তাই সবাই তাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলো। ঠিক করে বসতেই দেখে সাগরিকা সামনে।
“এইযে মিস রায়”
“প্লিজ সাগরিকা”
“সরি সাগরিকা বসুন বসুন”
“না আজ এমন একটা সুন্দর দিন এই বদ্ধ কাফেতে না বসে চলুন একটু ঘুরে আসি”।
“কোথায়?”
“বেরিয়ে তো পড়ি তারপর দেখা যাবে”
আজ ওকে একটু ভালো লাগছিলো। সেই ছাপা শাড়ি আর বিনুনি করা চুল তবে কাঁধের বিচ্ছিরি ঝোলাটা আর হাতের বইগুলো নেই তার জাগায় বেশ মানানসই একটা হ্যান্ডব্যাগ।
“আচ্ছা বলুন তো গঙ্গার ধারে কোনোদিন চিনে বাদাম খেয়েছেন”
সৈকত মাথা নাড়লো। “বৌকে নিয়ে কোনোদিন গঙ্গার ধরে বেড়াতে যাননি?”
আবার মাথা নাড়লো সৈকত। তারপর খটকা লাগলো “আমার বিয়ে হয়েছিল কে বললে”
“সৈকত বাবু আমরা একটু ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করি, এও জানি যে আপনি একজন অসাধারণ রাধুনে, ঠিক?”
লজ্জা পেয়ে বললো “অসাধারণ কিনা জানি না তবে রান্না করতে ভালোবাসি”
সাগরিকা সেদিন সৈকতকে নিয়ে মিলেনিয়াম পার্কে গেলো। গঙ্গার ধারে আড়াই কিলোমিটার লম্বা এই উদ্যান দেখে সে মোহিত হয়ে গেলো। সে জানতোই না এইরকম একটা জায়গা এই শহরে আছে। তারা একটা বেঞ্চে চুপ করে বসলো। শীতকালের পড়ন্ত বেলার মিঠে রোদে বেশ লাগছিলো সাগরিকাকে। এই সময় ইচ্ছে না করলেও না জিজ্ঞেস করে পারলোনা সৈকত “আমার কেসটা কি হবে?”
তার দিকে না তাকিয়ে বললো “আপনার কেসটার এবার সমাধান হবে, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে” তারপর তার দিকে তাকিয়ে বললো “ব্যাপারটা কি জানেন সৈকত বাবু, জীবনটাকে উপভোগ করতে শিখুন, এইরকম জায়গায়, এইরকম পরিবেশ, ওই বাক্সটার কথা না ভাবলেই কি নয়”
“না সেই রকম না তবে” বলে চুপ করে গেলো। সে অনুভব করলো তার কাঁধে মাথা রেখে তার হাত ধরে সাগররিকা অপলকে চেয়ে আছে গঙ্গার দিকে। সৈকত বুঝতেও পারলো না যে তার অজান্তে তার ঠোঁটের কোন এক ফালি হাসি ফুটে উঠেছে।
“তাহলে কবে আসবেন বাক্সটা দেখতে?”
“আমি সাধারণত রবিবার কাজ করি না, তবে এবার একটু ব্যতিক্রম করবো, লম্বা ছুটি কাটিয়ে এলাম তাই, এগারোটা নাগাদ এলে হবে”
“হ্যা হ্যা খুব হবে”
শনিবার রাতে ভালো ঘুম হলো না খালি ভাবছিলো কাল সাগরিকা আসবে, কি করবে, কি খাওয়াবে, কি বলবে। একটা ঘটনা সে লক্ষ করলোনা। রাতে যখন ডালা খুলে পুতুলটা নাচলো, সৈকত বিরক্ত ভাবে তাকিয়ে রইলো আর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডালা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। ভোর বেলা অ্যালার্ম বাজার আগেই উঠে পড়লো। ঘর দোর পরিষ্কার করে, জায়গার জিনিস জায়গায় রেখে বাজারে ছুটলো। রান্না চাপিয়ে টুকটাকি কাজ সেরে নিলো। সুক্ত, পাতলা মুসুরির ডাল আর মাছের ঝোল করতে কতক্ষন আর লাগে, শুধু ভাত আর পোস্তর বাড়া ভাজাটা খাওয়ার আগে করে নেবে। এগারোটার মধ্যে চান টান করে রেডি হয়ে বসলো। ঠিক সময় সাগরিকা এসে হাজির হলো। তাঁকে দেখেই এক গল্ হাসি ফুটে উঠলো। বেশ দেখতে লাগছে ওকে। বিনুনির জাগায় খোঁপা, ছাপা শাড়ীর বদলে সিল্কের শাড়ী সুদু সেই মোহময়ী পারফিউম গন্ধে সারা ঘর খেলে উঠলো। খুব যত্নসহকারে তাঁকে অভিবাদন করে এক কাপ হট চকলেট দিলো। এক চুমুক দিয়ে সে আরাম করে বসে বললো “কই”
“কি কই”
“অরে বাবা বাক্সটা”
“ওহ হ্যা ওটা ভেতরে আছে”
“নিয়ে আসুন, দেখী”
সৈকত ভাবলো ওটা দেখেই যদি চলে যায়, তাই এতো দ্বিধা করছিলো। বাক্সটা খুব মন দিয়ে উল্টে পাল্টে খুঁটিয়ে দেখলো।
“এটা কি সেই বাক্সটা”
“মনে তো তাই হচ্ছে, সেই রকম কারুকার্য, সেই মিষ্টি আওয়াজ, শুধু একটু বেশি প্যাঁচ দিতে হচ্ছে” “ও”
“আমি এটাকে নিয়ে গেলে ভালো হতো” সৈকত মাথা নাড়ছিলো
“ঠিক আছে আমি এটা বেঁধে দেব. আপনি একটু লখ্য রাখবেন”
“কি রকম”
“রোজকার মতন না অন্য কিছু, আপনার পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আমার পরের অ্যাকশন নির্ভর করছে” মাথা নেড়ে শায় দিলো সৈকত।
“তাহলে উঠি আজকে?”
শুনে সৈকত ঘাবড়ে গেলো “কেন”
“কেন মানে আপনি একটা দিন ছুটি পান, আরাম না করে আমার সাথে বসে কি হবে?”
“তাহলে এতো রান্না করলাম যে, কি হবে?”
“কেন খামোকা কষ্ট করতে গেলেন”
“না না কষ্ট কেন, সচরাচর আমার বাড়িতে কেউ আসে না, তাই ভাবলাম, আর আমি মোটামোটি ভালো রান্না করি, আপনি তো জানেন”
“লোভ দেখালেন তো, ঠিক আছে, আপনার রান্না খেয়েই যাবো নয়”
“তাহলে খাবার বাড়তে থাকি”
“এতো তাড়াতাড়ি?, আমি দেড়টা দুটোর আগে খাইনা”
“বেশ বেশ, আরাম করে পরে খাওয়া যাবে”
খানিক্ষন চুপ করে থেকে সৈকত জিজ্ঞেস করে “আপনার সম্পর্কে তো কিছুই জানি না”
“আমার তেমন কোনো গল্প নেই, ভবানীপুরে এক লেডিস হোস্টেলে থাকি, কোচবিহারের কাছে বাঘমারা বলে এক গ্রামে বাড়ি, গ্রামের স্কুলে পড়াশুনা সেখান থেকে কোচবিহার কলেজ, সাইকোলজি নিয়ে পাস করে কলকাতায় আশা, এই আর কি”
“আর এই চাকরিটা?”
“এটা ঠিক চাকরি না, আমরা একটা সংস্থা চালাই যাতে কিছু লোকের উপকার হয়”
“মানে কাজ আছে”
“আছে বেশ ব্যস্ত থাকি”
“আর টাকা পয়সা”
“আমার ভালো ভাবে চলে যায়”
“ও, বাড়িতে কে কে আছে?”
“সবাই আছে, আপনার বাড়িটা ভালোই”
সৈকত বুঝলো বাড়ি নিয়ে সাগরিকা কোনো কথা বলতে চায় না তাই আর ঘটালো না।
“ইয়ে মানে যতটা যা পারি আর কি”
“খুব সুন্দর সাজানো, দেখে মনে হয় না একটা ব্যাচেলরের বাড়ি, সবই কি আপনার করা?”
লাজুক ভাবে মাথা নেড়ে শায় দেয় সে।
দুপুরে খাবার সময় আবার এক রাশ প্রসংশার মুখে পড়লো সৈকত।
“হোস্টেলে থাকি আর ওখানের জঘন্য খাবার দুবেলা খেতে হয়, সে যে কি কষ্ট বলে বোঝানো ভার” বড়ো তৃপ্তি করে সাগরিকা পুরো খাবার খেলো, আরো মুগ্ধ হয়ে সৈকত তার দিকে চেয়ে রইলো।
“এই রকম যদি রান্না হয় তাহলে আমি প্রত্যেক রবিবার খেতে চলে আসবো”
“নিশ্চয় নিশ্চয়” বলে সৈকত প্রায় লাফিয়ে উঠলো।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো কিন্তু ওদের গল্প শেষ হলো না। সৈকত বুঝতেই পারলো না এরই মধ্যে কখন সাগরিকাকে আপনি থেকে তুমি বলে ডেকে ফেলেছে।
“পাঁচটা বাজে এবার উঠি”
“আর কিছুক্ষন বস না”
“না না আজকে একটু কাজ আছে”
“চা?”
“হ্যা হলে ভালো হয়”
চা নিমকি খেয়ে তারা বেরিয়ে পড়লো।
“চলো তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আশি” “তার কোনো দরকার নেই, মোড় থেকে ট্যাক্সি পায়ে যাবো”
“হ্যা তা পাবে তবুও”
“আমি গড়িয়াহাট যাবো। এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে”
“বয়ফ্রেইন্ড?”
“দুর”।
সৈকতের বেশ খুশি খুশি লাগছিলো। তার চোখে মুখে আনন্দ ফুটে উঠেছিল। মুচকি হেসে বাড়ির দিকে হাটছিলো। রাস্তায় কেষ্টদা দেখে বললো “কে রে, গার্লফ্রেইন্ড?” “দুর”।
অনেকদিন পর খুব ভালো ভাবে ঘুমোলো সৈকত। এক ঘুমে রাত কাবার। ঘুম থেকে উঠে ডালা বন্ধ বাক্সটা চোখে পড়ল। ঠিক মনে করতে পারলো না রাতে ওটা বেজেছিল কি না। বসে কিছুক্ষন ভাবলো নাহ কিছু মনে করতে পারলো না। এগারোটার সময় সাগরিকা ফোন করলো বাক্সটার খবর নিতে। সৈকত বললো “জানি না গো, এমন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম যে ওটা বেজেছিল কিনা জানি না, সকালে দেখলাম ডালা বন্ধ”
“হুমঃ হয়তো বেজেছিল আর আপনি গুমের ঘোরে ডালাটা বন্ধ করে দিয়ে ভুলে গেছেন”
“হতেও পারে” অস্বীকার করলো না সৈকত।
“তাহলে আজ রাতে একটু খেয়াল রাখবেন প্লিজ, আমি কাল আবার ফোন করবো”।
সেই রাতেও জেগে থাকতে পারলো না। সকালে উঠে ভাবার চেষ্টা করলো, আবছা মনে হলো সে হাত বিড়িয়ে ডালা বন্ধ করেছে কিন্তু স্পষ্টভাবে কিছু বলতে পারলো না। সাগরিকা ঠিক এগারোটায় ফোন করলো আর সৈকত সব কিছু জানালো। সব শুনে সে বললে “চেষ্টা করে যান সৈকত বাবু, জানতেই হবে বক্সটা করছেটা কি”। সৈকত শত চেষ্টা করেও পারলো না জেগে থাকতে, গুচ্ছের যত ঘুম যেন তক্ষুনি তার ঘাড়ে চড়েছে।
রোজ সকাল এগারোটায় সাগরিকা ফোন করে আর রোজ সৈকত বসে থাকে সেই কালটার জন্য। আসতে আসতে বাক্স ছাড়া সব রকম গল্প করতে লাগলো তারা। সৈকত নিজও বুঝতে পারলো না যে আজকাল সে কত কথা বলে।
“রবিবারে আসছো তো”
“কোথায়”
“আমার বাড়িতে”
“কেন”
“বাঃ রেঃ তোমার জন্য রান্না করবো তো”
“এই না না আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না”
“কোনো ব্যাপার না, তুমি সারা সপ্তাহ কষ্ট করো আর আমি এক দিন কষ্ট করবো, সোধ বোধ”
“না না আমার খারাপ লাগছে”
“প্লিজ এস না, না এলে আমার যে খারাপ লাগবে”।
এই রকম বেশ কিছু রবিবার তারা এক সাথে কাটালো আর সৈকত নতুন নতুন রান্না করে সাগরিকা কে খাওয়ালো।
শীত প্রায় যায় যায় এমন এক দিনে সৈকত সাগরিকা কে বললো “চলো গঙ্গার ধারে বাদাম ভাজা খাবে?”
“হটাৎ কি হলো আপনার”
“চলোই না দরকার আছে”।
দুজনে মিলেনিয়াম পার্কের সেই বেঞ্চটায় বসলো, সৈকত তার বাঁ হাতটা সাগরিকার কাঁধে রেখে একটু কাছে টেনে নিলো। সাগরিকাও তার মাথাটা সৈকতের বুকে হেলিয়ে দিলো। মুখটা নামিয়ে ফিস ফিস করে সৈকত বললো
“তোমাকে মিস রায় থেকে মিসেস সান্যাল করতে চাই, তুমি রাজি?”
সাগরিকা যেন এই দিনটার জন্য অপেক্ষে করে ছিল। সে মাথাটা আর একটু গুঁজে বললো “হ্যা রাজি”।
তার কিছু দিন পরে ওরা বিয়ে করলো। বড়ো সড়ো কিছু নয়, সাদা মাটা কোর্ট ম্যারেজ। সৈকতের অফিসের বন্ধুরাই সব ব্যবস্থা করলো। তারাই ছেলে আর মেয়ের পক্ষে সাক্ষ দিলো কারণ সাগরিকার বাড়ির কেউ আসেনি। সেই রাতে যখন সারা শহর ঘুমিয়ে পড়লো তখন সাগর সৈকতের মিলন হলো। কেউ কিচ্ছু জানতে পারলো না শুধু বাক্সের ডালা খুলে নীরবে পুতুলটা ঘুরে ঘুরে নেচে গেলো।
বিয়ের পর পাঁচ বছর কেটে গেছে। সাগরিকা আর সৈকত বেশ ভালোই আছে। তিন বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। তার নাম রেখেছে মোহনা।
ওঃ হ্যা সাগরিকার কার্ডটা সৈকত কোনদিন খুঁজে পায়নি। বাক্সটাও রহস্যময় ভাবে কোথায় উধাও হয়ে গেছে। আর ‘প্রেমলিনা সার্ভিসেস’ বলে কোনো সংস্থা ছিল না। ওই মিষ্টান্ন ভান্ডার আছে, পাশে ডাস্টবিনও আছে, তবে ওই রকম কোনো সিঁড়ি নেই আর ওই রকম কোনো বোর্ডও নেই। রশিদটি পেয়েছিলো কিন্তু সেটা একখানি সাদা কাগজে শুধু একশো টাকা লেখা। সৈকত ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাঁটায়নি কারণ তার একটা মস্ত বড়ো গুণ আছে, সে কোনো কিছুতে অবাক হয় না।