জীববৈচিত্রের সন্নিবেশ ও সমাহারে সৃষ্ট প্রকৃতি ও প্রতিবেশের ওপর ভিত্তি করে টিকে আছে আমাদের জীবন।সৃষ্টির সেরা জীব হলেও বিশ্বজুড়ে প্রতিবেশ বিনষ্ট এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তি মূলে রয়েছে মানুষের অপরিনামদর্শী কর্মকাণ্ড ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এই প্রকার কর্মকাণ্ড কে রোধ করে পরিবেশকে পুনরুদ্ধারের সংকল্প করা অন্যতম প্রধান কর্তব্য ।সেই কারণেই জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি উদ্যোগে 1972 সাল থেকে সারা বিশ্বে প্রতিবছর 5ই জুন দিবসটি পালন করে আসে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে। পরিবেশ সংরক্ষণের কর্মসূচি গুলির মধ্যে অন্যতম পরিবেশ দূষণ রোধ করা, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা ,বৃক্ষরোপণ ,সামুদ্রিক প্রজাতির রক্ষা করা ,খনিজ সম্পদ রক্ষা করা প্রভৃতি।
আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশে একদিন এই পৃথিবীতে জীবন সম্ভব হয়েছিল ।তখন বায়ুমন্ডলে ছিল প্রানের বন্ধু অফুরন্ত অক্সিজেন ,খাদ্য জলেছিল সতেজ বিশুদ্ধতা যার ফলে জীবনে দ্রুত বিকাশ সম্ভব হয়েছিল পৃথিবীতে কিন্তু উন্নত মস্তিষ্কবান মানুষের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সূচিত হল অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে তার সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের অঙ্গ হিসেবেই সে নির্বিচারে প্রকৃতি সংহারকে করল তার প্রধান হাতিয়ার ।পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে আজ আর নেই সেই প্রথম দিনের বিশুদ্ধতার প্রতিশ্রুতি, পরিবেশে নেই জীবনের সুনিশ্চিত আশ্বাস ।সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে আবহাওয়ার দূষিতকরনের ব্যাপকতা ।এর ফলে ধীরে ধীরে বায়ুমণ্ডল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অক্সিজেন এবং মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা প্রকার অসুস্থতা ।পারমাণবিক যুগ মানুষের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে শান্তি। কেবলমাত্র মানুষই নয়, জীবজন্তু ও উদ্ভিদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে নানা প্রকার অস্বাভাবিকত্ব ।ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এর হাল ধরতে হবে ।বিজ্ঞান যেমন আমাদের জীবনে আশীর্বাদ স্বরূপ ,উন্নত প্রযুক্তির সূত্রপাত ঘটিয়েছে, অপরদিকে সেই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর বুকে চলেছে ধ্বংসলীলা ।ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদের দিকটিকে গ্রহণ করতে হবে ।তাদের বুঝতে হবে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে বিজ্ঞানকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়। বিলাসিতার মধ্যে হারিয়ে না গিয়ে সব কিছুকেই উপযুক্ত প্রয়োজনে কাজে লাগানোর শিক্ষা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য যেমন বিদ্যালয়ের ভূমিকা বর্তমান ,তেমন পিতামাতাদেরও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই বিষয়ে শিক্ষাদান করতে হবে।
বন্যপ্রকৃতি মানুষের নিকটতম প্রতিবেশী ।বনভূমি পৃথিবীর প্রথম আগন্তুক। মানুষের আগমনের পূর্বে সে এই ধরা তলে জন্ম নিয়ে মানুষের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তাইতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন তার বলাই গল্পে-
” ওই গাছগুলি বিশ্ব বাউলের একতারা
ওদের সজ্জার মধ্যে সরল সুরের কাঁপন
ওদের ডালে ডালে ,পাতায় পাতায়
এক তাল ছন্দের নাচন
যদি নিস্তব্ধ হয়ে প্রাণ দিয়ে শুনি
তাহলে অন্তরের মধ্যে মুক্তির বাণী এসে লাগে”
একদা সুপ্রাচীন ভারতবর্ষের তপবন বা অরণ্য থেকে সভ্যতার শঙ্খধ্বনি শোনা গিয়েছিল। কিন্তু মানুষ এই অবদান ভুলে গিয়ে অরণ্যবিনাশ এর মাধ্যমে পৃথিবীতে আহ্বান করে আনছে মরুভূমিকে।অরণ্য মরুভূমিকে প্রতিরোধ করতে পারে তাই পরিবেশ রক্ষার জন্য বনসৃজন একান্ত প্রয়োজনীয়।বর্তমান প্রজন্ম যদি এভাবেই বৃক্ষ সংহারকে উন্নতির চাবিকাঠি মনে করে ,তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোন প্রকার পৃথিবী বেঁচে থাকবে না ।তাইতো কবিগুরুর কন্ঠে প্রার্থনা ধ্বনিত হয়েছে-
” দাও ফিরে সে অরণ্য
লও এ নগর”
বনসৃজনের বিভিন্ন প্রকল্প গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে ।বৃক্ষরোপণ আবার প্রকৃতির বুকে ফিরিয়ে আনতে পারে সবুজের আহ্বান, স্নিগ্ধশীতল ছায়া এবং বিশুদ্ধ পরিবেশকে। সুতরাং পরিবেশ দূষণ রোধে বনসংরক্ষণের ভূমিকা অসীম।শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, জলদূষণ -সবকিছুর মূলে যেমন রয়েছে মানুষের লালসা এবং বিবেচনাহীন কর্মকাণ্ড , অরণ্য সংহারও মানুষের সেই একই কর্মের ফল। সুতরাং বিদ্যালয় কিংবা গৃহে ছোট ছোট বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শিশুদের মধ্যে বৃক্ষের প্রতি ভালোবাসাকে গড়ে তুলতে হবে । বৃক্ষ কেবল সুন্দর একটি পরিবেশে দান করে না, শিশুদের মধ্যে গড়ে ওঠে একাধিক গুণ ।একটি বৃক্ষকে নিজের যত্নে বড় করে তোলার মধ্য দিয়ে শিশুদের মধ্যে গড়ে ওঠে সংযম ,প্রকৃতি প্রেমের মত বহু গুণাবলী।
পরিবেশের একটি প্রধান অঙ্গ হল সামুদ্রিক প্রাণী ।বর্তমানে মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ফলে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বহু সামুদ্রিক প্রজাতি। সমুদ্র পরিবেশ সংরক্ষণ, সমুদ্রদূষণ রোধ ও সমুদ্র সম্পদের পরিবেশ সম্মত ব্যবস্থাপনা, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় জীববৈচিত্রের সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে উন্নয়নের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর “Blue Economy” কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই সকল পরিকল্পনা প্রকল্প বিষয়ে অবগত করার মধ্য দিয়ে সামুদ্রিক প্রাণীদের রক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে । পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ডলফিন এর মত উপকারী প্রাণী। তিমি মাছের সংখ্যা হাতেগোনা। এইভাবে যদি ক্রমশ আমরা পরিবেশ থেকে সামুদ্রিক প্রাণীদের হারিয়ে ফেলি, তাহলে পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে ।সামুদ্রিক প্রাণীদের প্রতি এই প্রকার ব্যবহার কখনই কাম্য নয় ,মানুষের লোভ-লালসার ফলে অকালে প্রাণ হারায় বহু বিরল প্রজাতি।তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে এই প্রকার লোভের বীজ যেন না ছড়ায় ,সেদিকে লক্ষ্য রাখা বিশেষভাবে প্রয়োজন।
কেবলমাত্র সামুদ্রিক প্রাণী নয় ,বন সংরক্ষণের পাশাপাশি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রতি নজর দিতে হবে। জাতিসংঘের তথ্য মতে প্রকৃতির ধ্বংসের বর্তমান ধারা চলতে থাকলে আগামী 10 বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপি প্রায় 10 লাখ প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে ।জলবায়ুর পরিবর্তন যেভাবে হচ্ছে তা যদি চলতে থাকে তাহলে 2070 সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রতি তিনটি প্রাণী উদ্ভিদের একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। গত 50 বছরে 7 শতাংশের বেশি বন্যপ্রাণী পেয়েছে। অরণ্যের সবুজ সমারোহ প্রাণের অস্তিত্ব আমাদের পৃথিবী কে অন্য গ্রহ থেকে আলাদা করেছে ।প্রাকৃতিক সম্পদ গুলির উপর ভিত্তি করে সময়ের সাথে সাথে করে তুলেছে তার সভ্যতা। অর্থই একমাত্র মূল্যবান বস্তু নয় , প্রাকৃতিক সম্পদ যে অর্থের থেকে অনেক বেশি মূল্যবান তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বোঝানো যায় ,এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সঙ্গে যদি তাদের জড়িত করা যায় তবেই হয়তো এই ধ্বংসলীলা বন্ধ করা সম্ভব হবে। অতীত ইতিহাসের পাতায় আমরা দেখেছি যে সময়ে নানা ধরনের বন্যপ্রাণী শিকার করাকে গৌরবের বিষয় বলে মনে করা হতো । এক শৃঙ্গ গন্ডার ,দাঁতাল হাতি প্রকৃত নানা বন্য জন্তুর শিকার এবং তাদের বিভিন্ন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা বাড়িঘর অলংকরণ, সমাজের বিশেষ মাপকাঠি বলে বিবেচিত হতো ।বর্তমানে সে প্রথা উঠে গেলেও ,চোর-চালানকারীদের অত্যাচার থেকে আজও তারা মুক্তি পায়নি ।সেই কারণেই দেশের মধ্যে বন্য প্রাণীদের জন্য মুক্তাঞ্চল স্থাপন করা হয়েছে ।জাতীয় স্তরে গঠন করা হয়েছে অসংখ্য রাষ্ট্রীয় উদ্যান ” National Park”। আন্তর্জাতিক স্তরে তৈরি হয়েছে নানা ধরনের আইন যা প্রতিটি দেশের জন্য মেনে চলা বাধ্যতামূলক IUCN এর মতন বিভিন্ন সংস্থা রীতিমতো পরিসংখ্যান অনুযায়ী হিসেব করে বন্যপ্রাণী রক্ষায় বিশেষ ভাবে উদ্যোগী হয়েছে ।
পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অপর একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নজরে দেওয়া প্রয়োজন তা হল খনিজ সম্পদ রক্ষা। সম্পদের মধ্যে অন্যতম কয়লা, গ্যাস এবং তেল যা জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই জ্বালানি সংকট বিশ্বের সমস্যা গুলোর মধ্যে একটি ।কয়লা, খনিজ তেল ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে আজ প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায় ।সুতরাং বিশ্ববাসীকে অবশ্যই এ বিষয়ে এখন থেকেই সতর্ক হতে হবে নয়ত জীবাশ্ম জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ।বিজ্ঞান কে কাজে লাগিয়ে ব্যবহারযোগ্য শক্তি যেমন গোবর গ্যাস, বায়ু কল,নদীর স্রোত, সৌরশক্তি, প্রভৃতির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায়, কিংবা এই প্রকার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জ্বালানি প্রস্তুত করা যায় তাহলে হয়তো খনিজ সম্পদ নষ্ট হয় না ।ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্মুখে এক বড় রকমের বিপদ। সেই কারণে তাদেরই সেই কারণে তাদেরই এই প্রতিকার করতে হবে । উপযুক্ত শিক্ষা দানের মধ্য দিয়ে এই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
সুকান্ত ভট্টাচার্য চেয়েছিলেন এ পৃথিবীকে শিশুদের জন্য বাসযোগ্য করে যেতে। তার স্বপ্ন হয়তো এখনো পূরণ হয়নি কারণ পরিবেশ এখন সংকটের সম্মুখীন ।পরিবেশ দূষণ এবং আরও নানা কারণে মানুষ আজ ভয়ঙ্কর সব অসুখের সঙ্গে লড়াই করে আসছে। যদিও এর পিছনে মানুষের বিবেচনাহীন ক্রিয়াকর্ম দায়ী ।ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেহেতু পৃথিবীর উত্তরাধিকারী ,তাই বর্তমান প্রজন্মকে তাদের চোখে পরিবেশ সংরক্ষণের স্বপ্নকে জাগিয়ে দিতে হবে। যাতে তারা পরিবেশের অর্থ বুঝে তাকে রক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে ।এই ভাবেই হয়তো একদিন পৃথিবীর বুকে সবুজ ফিরে আসবে ,মানুষ আবার প্রাণ ভরে শ্বাস গ্রহণ করবে, এই পৃথিবীতে ফিরে আসবে বিশুদ্ধতার আশ্বাস ।কবি আবার গিয়ে উঠতে পারবেন –
“মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে
হে প্রবল প্রাণ
ধূলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে
হে কোমল প্রাণ”।।