অতিমারী, সমগ্র বিশ্বজুড়ে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে রোগাক্রান্ত হওয়া, ২০২০-র আগে শুধুমাত্র ইতিহাস বইতেই পড়া ছিল। যেখানে উল্লেখ ছিল মৃত্যু মিছিলের, মানুষের অসহায়তার। আমরা, ছাত্র সমাজ, শুধু তথ্য হিসাবে যেগুলি মুখস্ত করছিলাম, ২০২০-র পর তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়।
কি এই কোভিড – ১৯? এটি একপ্রকার ভাইরাস ঘটিত সংক্রামক রোগ। চিকিৎসার সঠিক কোনো ওষুধ নেই। ন্যূনতম ২০ দিন হাসপাতালে থাকা আবশ্যক। তবে বাঁচা মরা ভগবানের হাতে। ফলে প্রতি রোগী হাসপাতাল বেডে ওই ২০ দিনের জন্য আটকা পরে যায়। এদিকে দ্রুত সংক্রমণের ফলে রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধনশীল। ফলস্বরূপ ন্যূনতম চিকিৎসাও হয়ে পরে অমিল। এই চিত্র শুধুমাত্র কোনো তৃতীয় বিশ্বের দেশের প্রান্তিক শহরের ছোট হাসপাতালের চিত্র নয়, এই চিত্র সমগ্র বিশ্বের।
যেকোনো দেশের কাছে সবচেয়ে দামি সম্পদ তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। তাই এই অতিমারীর প্রকোপ থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কে সুরক্ষিত করতে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটানো হয়। বিদ্যালয়ের , মহাবিদ্যালয়ের, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পঠন-পাঠন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। উপযুক্ত পরিকাঠামোযুক্ত বিদ্যালয়, প্রতিদিনের শ্রেণীকক্ষের পঠনপাঠনকে “অনলাইন ক্লাসরুম” এ স্থানান্তরিত করে। এখানে ছাত্র এবং শিক্ষক দুজনেই নিজের বাড়ি থেকেই স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি যন্ত্রের সাহায্যে একত্রে মিলিত হয় এবং একসাথে পড়াশোনা পুরোদমে চলতে থাকে। কোনো বাধা শিক্ষার গতিকে থামাতে পারেনা।
কোভিড- ১৯ সংক্রমণ হারে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন অবস্থানে আছে, এবং অতিমারীর কারণে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ইত্যাদি প্রভৃতি বন্ধ হয়ে যাওয়া সারা পৃথিবীতে ১৮৬ দেশ জুড়ে কোটি কোটি শিক্ষার্থী প্রভাবিত হয়েছে। আমরা বলতে পারি যে কোভিড- ১৯ অতিমারী আমাদের ডিজিটাল শিক্ষার প্রবর্তনের পথ প্রশস্ত করার সুযোগ দিয়েছে। ডেনমার্কে ১ ১ বছর বয়স পর্যন্ত যেই ছাত্রছাত্রীরা , তারা স্কুলে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে শুরু করেছে, যদিও এখনো ভারতবর্ষে পাঠকরা “গুগল মীট”-এর মাধ্যমে রোল কল এর সারা দিচ্ছে।
উপযুক্ত পরিকাঠামো বিহীন বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ বিভিন্ন পাঠ্যবই থেকে তথ্য হোয়াটস্যাপ, গুগল ক্লাসরুম-এর মাধ্যমে ছাত্রদের কাছে পৌঁছে দেন। ছাত্ররা নিজ সময় সেগুলো অধ্যয়ন করে। পশ্চিমবঙ্গে বহু বিদ্যালয়ে স্মার্টফোনে কেনার জন্য ছাত্রছাত্রীদের সমমূল্যের অর্থসাহায্য দেওয়া হয়। প্রতিকূলতার মধ্যেও ছাত্র-শিক্ষকের সহযোগিতায় শিক্ষাব্রত এগিয়ে চলে।
জনপরিচিত কোভিড-১৯ ভাইরাসের ফলস্বরূপ সারা বিশ্বজুড়ে সব স্কুলের অবসান দেখা গেছে। অন্ততপক্ষে 1.2 বিলিয়ন স্কুল অথবা কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে থাকার ফলপ্রসূ অনুভূতি থেকে দূরে সরে গেছে । ফলত, শিক্ষা এবং সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি, প্রচন্ডভাবে পরিবর্তিত হয়েছে । “অনলাইন ” পড়াশোনার এক পৃত্থিক উত্থান ঘটেছে যেটা সাম্প্রতিক পরিস্থিতি দেখে, মনে হচ্ছে আরও বহু বছর চর্চায় থাকবে । গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে অনলাইন পদ্ধতিতে পড়াশোনায় প্রথমত তথ্য মনে রাখতে আরও সুবিধে হয়, দ্বিতীয়ত, কম সময় দিতে হয়, এবং এই সময়টা প্রতি শিক্ষার্থী নিজের মতন করে সাজিয়ে নিতে পারে, এবং তৃতীয়ত, শিক্ষার্থীদের নিজের বাড়ির স্বস্তি থেকেই তারা ক্লাস করতে পারে । এর থেকে আমরা বলতে পারি, যে পরম্পরাগত শিক্ষাব্যবস্থাতে কোভিড- ১৯ যেই পরিবর্তনগুলো এনেছে, তা হয়তো ভাইরাসের হ্রাস-এর পরেও থাকতে পারে।
তবে বিপর্যস্ত হয় উচ্চস্তরের পরীক্ষা ব্যবস্থা। জনসমাগম রোধ এবং প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহার না করতে চাওয়ায়, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চস্তরের পরীক্ষাগুলি পরপর বাতিল হতে থাকে। সারাবছরের পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষার্থীদের গড় নম্বর দেওয়া হয়। ফলে এই মান অনেক ক্ষেত্রেই পক্ষপাত দুষ্ট বিবেচিত হয়, মূল্যায়ন সঠিক হয়না।
সরকার এবং প্রথমশারির কর্মীরা যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমানোর জন্য, কিন্তু ইতিমধ্যেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পড়াশোনা ছাড়াও বহুরকমের শারীরিক এবং মানসিক অস্থিরতা দেখা গেছে। মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিটি মানুষের জীবনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিজের চিন্তাভাবনার স্বচ্ছতা,সুস্থতা দ্বারাই একজন সুস্থ মানুষ গড়ে ওঠে। কোভিড-১৯ অতিমারীর কারণে বহুক্ষেত্রেই ছাত্রছাত্রীদের একাংশের মধ্যে একাকিত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিয়মানুবর্তিতার অভাব ,অনলাইন ক্লাস-এ সঠিকভাবে অংশগ্রহণ না করতে পারা, বন্ধুদের সাথে টিফিনের সময় “আড্ডা” না দিতে পারা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় দলবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ না করতে পারা – ইত্যাদি এই মানসিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ। গবেষণা থেকেও দেখা গেছে যে এই অতিমারীর প্রভাবে বহু ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রিয়জনকে হারানোর এক অজানা আতঙ্ক এক অস্থির মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করছে।
আবার, এই অতিমারীর প্রেক্ষাপটেও নিজজীবন বিপন্ন করেও দেশের কাজে ছাত্র যুবসমাজ ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নিজ উদ্যোগে অর্থ সংগ্রহ করে সেই অর্থে প্রয়োজনীয় ওষুধ, খাদ্যসামগ্রী ইত্যাদি পীড়িত দুর্গতের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে বহু ছাত্র সঙ্গস্থা। আমাদের মতন, বিপুল জনসংখ্যার দেশে স্বাভাবিকভাবেই আক্রান্তের সংখ্যাও বহু। সকল আক্রান্তের খবর প্রথমদিকে সরকারের কাছেও পৌঁছয়নি। এই সকল মানুষকে অছ্যুৎ না করে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের ছাত্রসমাজ মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে।
একসময় অক্সিজেনের যোগান প্রতি শহরে কমে যেতে থাকে। এই অক্সিজেন প্রতিটি রোগীর ক্ষেত্রেই অপরিহার্য্য। ফলে দেশ জুড়ে হাহাকার শুরু হয়। আবার তখন এই ছাত্র যুবসমাজ এগিয়ে আসে। নিজেদের চেনাজানা মধ্যে তৈরী করে “নেটওয়ার্ক”। সারা শহরের অক্সিজেন বিক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। ফলে প্রয়োজনের কথা জানার কিছুক্ষনের মধ্যেই অক্সিজেন বিক্রেতার সাথে গ্রাহকের যোগাযোগ করে দেয়া হয়।
এই বর্তমান জনস্বাস্থ্য সংকটটি প্রমাণ করে যে যুবসমাজের সকলেই পরস্পর সংযুক্ত এবং আমাদের মঙ্গল অন্যের সংস্থার উপর নির্ভরশীল। সব অসুবিধাই আমরা অতিক্রম করতে পারি এবং পারবো। কোভিড- ১৯ অতিমারী বহু নতুন জিনিস তুলে ধরেছে আমাদের সামনে, এবং ভালো দিক, খারাপ দিক- সবমিলিয়ে আমরা জীবনের এক নতুন গতিধারা খুঁজে পেয়েছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ভবিষ্যতেও যেকোনো সমস্যার সমাধান আমরা একত্রে খুঁজে বের করতে পারবো, যতই জটিল হোক না কেন। সবমিলিয়েই হয় জীবন, সব নিয়ে চলতে হয়।
“শ্মশানের বুকে আমরা রোপণ করেছি পঞ্চবটী,
তাহারি ছায়ায় আমরা মিলাব জগতের শত কোটী।”