ভূমিকাঃ-
” ছাত্র মানেই মহান নেতা, আগামীর মহাবীর
ছাত্র মানেই অবিচারে উন্নত তব শির …”
সত্যিই, আমাদের সমাজে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সমাজের সঠিক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে গেলে সর্বপ্রথম নতুন প্রজন্মকে সঠিকভাবে শিক্ষাদান অতি প্রয়োজনীয়। কিন্তু যদি এই শিক্ষাদানের মধ্যে কোথাও কোনো প্রশ্নচিহ্ন এসে যায়, তবে নিশ্চিতভাবে এর সরাসরি প্রভাব অবশ্যই সমাজের উপর পরে। যদিও এই শিক্ষাদানের চাকা সঠিক দিশাতেই গড়াচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎই এক দমকা হাওয়ায় সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। হঠাৎই এই শিক্ষার প্রগতির চাকা মহামারির চক্রব্যুহে পড়ে থমকে গেল। আর এই চক্রব্যুহ থেকে বেরোবার পথ কোনোভাবেই যেন পাওয়া যাচ্ছে না। এবং সর্বোপরি এর প্রভাব সমস্তকিছুর পাশাপাশি সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করছে আজকের তরুণ প্রজন্মকে – যা আগামীর বুনিয়াদ।
ছাত্রসমাজঃ-
“ছাত্রসমাজ এগিয়ে গেলে, এগিয়ে যাবে দেশ,
ছাত্রসমাজ নষ্ট হলে, দেশ হবে নিঃশেষ…”
ছাত্রজীবন – জীবনের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট সময়। এবং এই ছাত্র-ছাত্রীরাই দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। ভিত্তি সুদৃঢ় না হলে যেমন ইমারত দীর্ঘস্থায়ী হয় না, তেমনই ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের সোনালী সুযোগ যদি বৃথায় নষ্ট হয়, তবে ছাত্রসমাজের সর্বোপরি সমগ্র দেশের ভবিষ্যৎ ব্যর্থতায় পরিণতি পাবে। আজকের ছাত্ররাই আগামীর ভবিষ্যৎকে কাঁধে তুলে নেবে। তাই জীবনগঠনে ছাত্রজীবন অত্যন্ত মূল্যবান। তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলার এই চরম মুহূর্ত। আজকের এই প্রস্তুতির জীবনের উপর নির্ভর করে আগামীর সফলতা-ব্যর্থতা। এই ছাত্রজীবনই হল ভবিষ্যতের পল্লবিত সৌন্দর্যের অস্ফুট পটভূমি।
অতিমারী, তার ইতিহাস ও তার প্রভাবঃ-
সাধারণত কোনও অসুখ যখন স্বাভাবিকতা ছাড়িয়ে একটি সম্প্রদায় বা অঞ্চলকে আক্রমন করে, তখন তাকে মহামারি বলা হয়। কিন্তু প্যানডেমিক বা অতিমারী এর থেকে আলাদা। অতিমারী হল এমন এক মহামারি যা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে অথবা আন্তজার্তিক সীমানা ছাড়িয়ে কোনও বিশাল এলাকাজুড়ে প্রচুর মানুষকে আক্রমন করে। প্রকৃতঅর্থে মহামারির চেয়ে অতিমারী আরও বেশি ভয়াবহ। এর আগেও বহুবার বিভিন্ন মহামারির মুখোমুখি হয়েছে আমাদের এই ধরণী। সোয়াইন ফ্লু, স্প্যানিশ ফ্লু, দ্য গ্রেট প্লেগ ইত্যাদি বহু রোগের প্রবল ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে হয়েছে মানুষকে। প্রাণ হারিয়েছে বহু তরতাজা জীবন, নষ্ট করেছে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দকে, ছন্নছাড়া করে দিয়েছে এক তারের টানে বেঁধে রাখা জীবনযাত্রার প্রগতিকে। অতি ধনী থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত, দরিদ্র সবার উপরেই এর প্রভাব বর্তমান। তবে নিশ্চিতভাবে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের উপর এর প্রভাব চরমতম। মহামারির প্রভাবে চর্তুদিক এক অনিশ্চিত নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। এক পলকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শিল্প, কারখানা, অফিস, দোকান সবকিছুর চাকা। মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামে যেন আরোও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। কাজ হারিয়েছেন বহু মানুষ। অনেকেই হয়তো দিনের দু-মুঠো খাবারও জোগাড় করতে অক্ষম হয়ে পড়েছিল। ক্ষিদের জ্বালায় ছটফট করা শিশুটিকে হয়তো এক চুমুক জলেই শান্ত হতে হয়েছিল। শুধুমাত্র কর্মক্ষেত্রেই নয়, এই মহামারির সবিস্তার প্রভাব পড়েছে সমস্ত ক্ষেত্রেই। তবে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় প্রভাবই কোথাও হয়তো সবথেকেবেশি ক্ষতিগ্রস্থ করেছে শৈশবের ছাত্রাবস্থাকে।
ছাত্রসমাজের উপর অতিমারীর প্রভাবঃ-
মহামারির প্রভাব সমস্ত ক্ষেত্রেই বিশেষ প্রভাব ফেললেও সবথেকে বেশি চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে ছাত্রজীবনের উপর। এই প্রভাব শুধুমাত্র যে বর্তমানকে নষ্ট করছে, তা নয়, এর সাথে সাথে পুরোপুরিভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে আগামী ভবিষ্যৎকে। আজকের শিশুরাই বা ছাত্ররাই আগামীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ, কিন্তু যদি এই বর্তমান সঠিক শিক্ষালাভই না করতে পারে, তবে ভবিষ্যতের আকাঙ্খা নিছকই সোনার-পাথর-বাটির চাহিদার মত। যাকে শব্দ হিসাবে ব্যবহার করা গেলেও বাস্তবে ভিত্তিহীন। করোনা অতিমারীর কালে অনেক প্রতিষ্ঠানই অনলাইন শিক্ষাদানের ব্যবস্থা শুরু করে। যদিও আর্থিক কারনে অনেকেই এ থেকে বঞ্চিত। অনলাইনে ভিডিও কলিং-এর মাধ্যমে সৌজন্য সাক্ষাৎ বেশ আনন্দদায়ক হলেও শিক্ষাব্যবস্থাকে সবসময় অনলাইনে পরিপূর্ণ রূপ প্রদান করা সম্ভবপর হয় না। অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি অনলাইন পরীক্ষা এবং তার ভিত্তিতে তার আগামীর মূল্যায়ণ নিশ্চিতভাবে ছাত্রসমাজকে এক চরম হতাশাও অপূর্ণতার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের শুধুমাত্র একাংশই যে এই সমস্যার মুখোমুখি তা নয়, বরং এর থেকেও খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি নব-অঙ্কুর ন্যায় শিশু প্রজন্ম। যে বৃক্ষচারার জন্ম ও বাড়বৃদ্ধি মাটিতে হওয়া প্রয়োজন, বর্তমান পরিস্থিতি তাকে যেন শুধুমাত্র মাটির একটি চিত্রের মধ্যেই বেড়ে উঠতে বাধ্য করেছে। এমতাবস্থায় সে মাটির রূপ সম্বন্ধে ধারণা তৈরী করলেও তার প্রকৃতি ও বিশেষত্ত্ব কিছুই জানল না। একটা বাচ্ছা জন্মাবার পর তার যখন সঠিক শিক্ষার বয়স তখন যদি একটা শিশু স্কুলে ভর্তি হয়েও যায়, তাহলেও সে জানতেই পারছে না যে স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা কাকে বলে। তার ফলে স্কুলের বন্ধুবান্ধব ও স্কুল পরিষেবার মতো জায়গা থেকে তারা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তারা শুধু ফোনটাকেই জানতে পারছে, জানছে না স্কুল-জীবন। একটি বিদ্যালয় একটি শিশুর কাছে শুধুমাত্র চার দেওয়ালে বদ্ধ ঘর নয়, বরং তার বেড়ে ওঠার রসদের সিংহভাগ সে পায় এই জায়গা থেকে। এখান থেকেই তার নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খলা শেখার প্রাথমিক ধাপ শুরু হয় এবং যা শুধুমাত্র বিদ্যালয়ে সশারিরীক উপস্থিতির মাধ্যমেই পাওয়া যায়, কোনো অনলাইন
ক্লাসের মাধ্যমে নয়। শিশুদের এই মহামূল্যবান সীমিত সময় অপচয় হচ্ছে মহামারির কালচক্রে। যে ছাত্র বা ছাত্রীটা প্রথমবার কোনো বোর্ডের পরীক্ষার অভিজ্ঞতা করে তার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপে পৌছাতে চেয়েছিল, সে জানতেও পারলনা এই আসল আনন্দ-ভয় মিশ্রিত অনুভূতিটার সম্বন্ধে। অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তারা জানতেও পারল না যে তারা কতটা উপযুক্ত আগামী দিনের জন্য। শুধুমাত্র বিদ্যালয় নয়, এর প্রভাবে প্রভাবিত উচ্চশিক্ষাও। যে প্রযুক্তিকে শিখতে গেলে তাকে হাতেকলমে জানা ভীষণ প্রয়োজনীয়, সেই শিক্ষাও এখন অনলাইনে। এতে তাদের যোগ্যতার প্রমাণপত্র কাগজে কলমে তো থাকছেই, কিন্তু বাস্তবে তার নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে কে কতটা যোগ্য সে ব্যাপারে একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যাচ্ছে ! এবং এর ক্ষতিকারক প্রভাবের ফলে দেশের বেকারত্ত্বের গ্রাফও ক্রমশ উর্ধ্বমুখী হচ্ছে। এর পাশাপাশি অতিরিক্ত ফোনের ব্যবহার তার মস্তিষ্ক ও চোখের উপরেও বিশেষভাবে প্রভাব ফেলছে।
উপসংহারঃ-
আজ যদিবৃক্ষ সঠিক পুষ্টি পায়, তবেই তার থেকে আগামীদিনে ফলের প্রত্যাশা করা সম্ভব। যে বৃক্ষ ছোট থেকেই সঠিক চর্চার অভাবে বড়ো হচ্ছে, তার থেকে আগামীদিনে বিশেষ উপকারী কিছু কখনোই পাওয়া সম্ভব নয়। আজকের ছাত্রসমাজ যদি সঠিক শিক্ষাই না পেতে পারে, তবে তারা আগামীদিনের ভবিষ্যতকে কী শিক্ষা দেবে ? ছাত্রসমাজ আগামী ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল জ্বলন্ত শিখা। এই শিখাকে আগামীতেও উজ্জ্বল রাখতে চাইলে এর জন্য সঠিক জ্বালানী জোগান দেওয়া অতি প্রয়োজনীয়। আজকে এই আগত অতিমারী পরিস্থিতি মনুষ্যসৃষ্ট কিনা, সে ব্যাপার এখনও পরিষ্কার না হলেও অবশ্যই এতে মানুষেরই ভূমিকা রয়েছে, কিন্তু এই পরিস্থিতি কাটিয়ে আমরা একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবোই। সেদিন আবার সব পুরানো ছন্দে ফিরবে। কিন্তু এর জন্য আমরা আজ যা হারাচ্ছি তা কখনোই আর ফিরিয়ে আনতে পারব না। তাই এই পরিস্থিতিতেও ভবিষ্যতকে বাঁচিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে। ছাত্রসমাজকে অবহেলা করে এগিয়ে গেলে ভবিষ্যতে এর দায় আমাদেরই নিতে হবে। কালের নিয়মে যে অতিমারী তার প্রভাব বিস্তার
করেছে, সে আবার কালের নিয়মেই তার অস্তিত্ত্বকে হারাবে। কিন্তু ততদিন আমাদের সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ছাত্রসমাজকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। যাতে আগামীতে আবারও যদিকখনও অতিমারী ফিরেও আসে, তাকে প্রতিহত করার মতো সঠিক জ্ঞানী ও যোগ্য ব্যক্তির যেন অভাব না হয়.. ৷৷
তথ্যসূচি :-
১. ছাত্রমৈত্রী । htps/banglarkobita.com/poem/view/47762 ]
২. [ https://www.myallgarbage.com/2017/10/role-of-the-student-community-in-
building-rnation.html?m=1 ]
৩. U. [ https://thebengalstory.com/pandemic-in-history/ ]