মারী কথার অর্থ মরক আর তার পূর্বে অতি উপসর্গ যোগ করে অতিমারী শব্দটি তৈরী হয়েছে। অতিমারী কে মহামারী বলেও অভিহিত করা হয়। যখন পৃথিবীব্যাপী বহু মানুষ কোনো একটি কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তখনই তা মহামারী বা অতিমারী হিসাবে আখ্যায়িত হয়। আজ এমনই এক বিশ্বব্যাপী মহামারীর কবলে আমরা আর আমাদের ছাত্রসমাজ। যারা বর্তমানের সদাজাগ্রত প্রহরী আর ভবিষ্যতের কান্ডারী । পৃথিবীর এই ঘোরতর দুর্দিনে ছাত্রসমাজের রয়েছে বিশেষ কর্তব্য ও দায়িত্ব ।
অতিমারী যখন কোন রোগ বা অসুখের দ্বারা ছড়ায় তখন সেই রোগ হয় সাধারণতঃ ছোঁয়াচে রোগ আর কোন রোগ ছোঁয়াচে হলে তা মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। আর এই একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ প্রতিনিয়ত নিজের রাজ্যে শুধু নয়, কাজের সূত্রে ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে বিদেশে, আর তার সঙ্গে সেই ছোঁয়াচে রোগের ভাইরাসও মানুষ থেকে মানুষে বাহিত হতে হতে ছড়িয়ে পরে দেশে দেশান্তরে, তখন তার প্রবাহে গণ্ডী টানা মানুষের পক্ষে সহজে সম্ভব হয় না। সেই রোগের ভাইরাস হয়ে পড়ে মানুষের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী আর তার আক্রমণে ছারখার হয়ে যায় প্রতিটি দেশের সমাজ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর তার সঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে দেশের অর্থনীতি । মানুষের মনে জন্মায় ভয়, হতাশা, প্রভৃতি ।
যখন দেশের সমাজ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি প্রভৃতি ভেঙ্গে পড়ে তখন সব মানুষের মত ছাত্রসমাজ-ও এর দ্বারা প্রভাবিত হয় কারন ছাত্ররাও যে এই সমাজেরই অঙ্গ। তারা এই সমাজের অঙ্গই শুধু নয়, এই সমাজের ভবিষ্যৎ চালিকাশক্তি । তারাই তো দেশের ভিত্তি । তারাই তো দেশকে এগিয়ে নিয়ে পৌঁছে দেবে বিশ্বের অঙ্গনে, তাদের নিজ নিজ দেশকে করবে গৌরবান্বিত। তারাই তো ভবিষ্যতে অনন্ত, অসীম বিশ্বকে নিয়ে আসবে মানুষের দোরগোরায় । সেই জন্য ছাত্রসমাজ মহামারীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়া মানে দেশের ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।
২০১৯-এর শেষ থেকে যখন নভেল করোনা ভাইরাসের আক্রমণ দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল,এল এক নতুন অসুখ কোভিড ১৯ এবং নিকট ভবিষ্যতেই তা রূপনিল অতিমারীর । তখন পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মতো আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ তথা আমাদের গর্বের দেশ ভারতবর্ষও এর হাত থেকে রক্ষা পেল না, দেশে শুরু হল হাসপাতালে বেডের জন্য হাহাকার, অক্সিজেনের জন্যে হাহাকার, শুরু হল মানুষের মৃত্যুমিছিল যা ত্রখনও অব্যাহত। শুধু দেশের মানুষই আক্রান্ত হল না, আক্রান্ত হল দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অর্থনীতি, আর তার সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হল ছাত্রসমাজ । কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস আজ পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, ইতিহাস সাক্ষী অতীতেও এবাধিক বার সারা বিশ্বে এমনই কয়েকটি মারণ ব্যাধি সর্বশক্তিমান মানুষের উপর করাল থাবা বসিয়েছিল। এই একুশ শতকে করোনা সে ভাবেই আবাল বৃদ্ধ বনিতাকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুমুখে। বিশেষজ্ঞদের মতে আজ এই অতিমারীর তৃতীয় ঢেউ আসন্ন, প্রথম ঢেউয়ে ষাটোৰ্দ্ধ বয়স্ক ব্যক্তি, দ্বিতীয় ঢেউয়ে মধ্য বয়সী তরুণ সমাজ আর আগামী ঢেউয়ে হয়তো এই ভাইরাস প্রাণ কাড়বে নাবালকদের । তাই স্বাস্থ্য, নিরাপত্তার কারণে ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষা আজ বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ ছেড়ে গৃহবন্দী ইন্টারনেট মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
করোনার শুরু থেকেই বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় সকলই বন্ধ, যার ফলে প্রায় বন্ধ পঠনপাঠন। ইংরেজী মাধ্যম বিদ্যালয়গুলি এবং কিছু বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়গুলিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পঠনপাঠন শুরু হলেও আমাদের ভারতবর্ষের মতো গরীব দেশে সকল ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে স্মার্টফোন কিনে এবং অর্থের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করা আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র । এযেন তাদের কাছে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা, কারণ তাদের যে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আর গত বছর যাদের প্রথম শ্রেনীতে পঠনপাঠন শুরু হওয়ার কথা ছিল, তাদের পঠনপাঠন শুরু হয়ইনি আর বোঝাও যাচ্ছেনা কবে শুরু হবে! হয়তো যখন বিদ্যালয় খুলবে তাদের পড়ার কথা থাকবে তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে এবং এখন বিদ্যালয়ে গিয়ে পঠনপাঠনের অভাবে তাদের একটা বড় অংশ শুধুই খেলাধূলায় মত্ত । তাদের পঠনপাঠন কিভাবে শুরু হবে বা আদৌ হবে কিনা অর্থাৎ তারা স্কুলছুট হয়ে যাবে কিনা তা নিয়ে একটা বড় আশঙ্কাতো থেকেই যায় । সার্বিক ও সামাজিক কল্যাণের মন্ত্রে দীক্ষিত ছাত্রসমাজের যুক্তির দ্বারা বিচার করার মতো বৈশিষ্ট্য এই করোনা অতিমারীর আবহের বেড়াজালে অনেকটাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যালয় বিহীন এই শিক্ষা ছাত্র সমাজের শৃঙ্খলা, সার্বিক জ্ঞানবোধের মেরুদন্ডকে অনেকটাই আঘাত করেছে, যাতে দুর্বল হচ্ছে তাদের ভিত, দেশ ও জাতির আগামী ভিত্তি।
সচেতনতাই পারে যে কোনো লক্ষ্যকে সার্থক করতে । শিক্ষার লক্ষ্যের অন্যতম দিক হলো সমাজের সঙ্গে তার সাযুজ্য ও সংগতি স্থাপন । স্বামীজি তাই বলেছেন, “শিক্ষা হল মানবের অন্তর্নিহিত সত্তার জাগরণ ।” বর্তমানে দেখা যাচ্ছে এ দেশের ইংরাজী মাধ্যম বিদ্যালয়গুলিতে ‘অনলাইন’ পঠনপাঠনকে যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদান ও পরীক্ষা গ্রহণ করে দুর্বল হয়ে পড়া শিক্ষা ভিতকে উন্নত করার প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামোে ও আর্থিক সমস্যার কারণে সরকারী এবং সরকারী অনুদান পোষিত বিদ্যালয়গুলিতে সেভাবে শিক্ষাদান সম্ভব হচ্ছে না । ফলতঃ শিক্ষাগ্রহণ ও পরীক্ষাপ্রদান নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে জন্ম নিছে তীব্র অনীহা, হতাশা । গ্রাম্যস্তরে তা আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। তাই আজ ছাত্রসমাজ, অভিভাকমন্ডলী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাবিদ, তথা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সুচিন্তিত সচেতনতা বোধই পারে অতিমারীর কবলে পড়া শিক্ষার ভাঙনকে রোধ করতে ।
ছাত্রসমাজ অধিকাংশই ঘরবন্দী থাকছে। তারা খেলাধূলা করতে পারছে না ৷ বাড়িতে এই ভাবে থাকতে থাকতে অনেকেই হয়ে উঠছে জেদী, বদরাগী ৷ ছাত্রছাত্রীরা মোবাইল, কম্পিউটারের সঙ্গে দিনের অনেকটা সময় ব্যায় করার ফলে তারা কিছু জানার জন্যে গুগল-এর উপর নির্ভর করছে। তারা গল্পের বই পড়ার বদলে সেই গল্প ইন্টারনেটে দেখে নিচ্ছে। এতে তারা হারিয়ে ফেলছে নতুন নতুন শব্দের ব্যবহার ৷ ক্ষতিগ্রস্ত হছে তাদের চিন্তাশক্তি আর তাদের নতুন কিছু করে দেখানোর ইচ্ছা ৷ তারা সবকিছু থেকে ক্রমাগত নিষ্প্রতিভ থাকছে। তাই আজ সময় এসেছে ছাত্রসমাজকে সমস্ত বিপত্তি থেকে বাঁচাবার। প্রত্যেক অভিভাবককে এখন তাদের প্রতি আরো যত্নশীল হতে হবে। তাদের প্রতি রাখতে হবে কঠিন কিন্তু স্নেহ মিশ্রিত নজর, যাতে তাদের সমস্ত অভাব পূরণ করা যায় ।তাদের বাড়িতেই যোগাসন বা প্রাণায়ামের মাধ্যমে শরীর ও মনের বিকাশ ঘটাতে হবে, যাতে আটকানো যাবে তাদের শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা। পড়াশোনা ছাড়াও তাদের বিভিন্ন ছোট ছোট বাড়ির কাজে ব্যাস্ত রাখতে হবে, যাতে অলস সময় তারা মোবাইল ফোন নামক ওই ক্ষতিকারক বস্তু থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে পারে ।
পৃথিবীর সমস্ত শিক্ষাবিদের একত্র হয়ে চিন্তা করা উচিত বিদ্যালয়ে না গিয়ে, ইন্টারনেটের ব্যবহার না করে কিভাবে এই অতিমারীর মধ্যেও ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব, এবং চিকিৎসকদের নজর দিতে হবে কিভাবে বাড়িতে বন্দী হয়ে থেকেও ছাত্রছাত্রীরা জেদী বা বদরাগী না হয়ে ওঠে। ছাত্রসমাজ যেন তাদের কল্পনাশক্তিকে আরো ত্বরান্বিত করতে পারে আর রাখতেপারে নিজ নিজ দেশের এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার। আর এই ছাত্রসমাজকে অতিমারীর হাত থেকে রক্ষা করাই হয়ে ওঠে দেশের পরিচালকদের এক অন্যতম লক্ষ্য, কারণ বাড়ি বাঁচাতে গেলে ভিত নষ্ট হতে দিলে হবেনা তাকে সযত্নে রক্ষা করতে হবে সমস্ত বাধা বিপদের হাত থেকে । একদা ছাত্রসমাজের উদ্দেশ্যে কবি গেয়েছিলেন- ‘আমরা শক্তি আমরা বল, আমরা ছাত্রদল ।’ ক্ষয়িষ্ণু এই শিক্ষাব্যবস্থায় দেশের সকল মানুষের দায়িত্ব ছাত্রসমাজের পাশে থাকা আর তাদের সাথে নিয়ে নতুন উদ্যম নতুন ভাবনায় অতিমারীর চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে শিক্ষাস্তরের উন্নয়ন ঘটানো তথা ছাত্রসমাজের মনোবল বৃদ্ধি করে কবির এই বাণীকে সার্থক করে তোলা ।