Montage

অতিমারী ও ছাত্রসমাজ

অতিমারী ও ছাত্রসমাজ

সালটা ২০২০,লোকে যন্ত্রণায় বলে বিশে বিশ।কি সেই যন্ত্রণা পরবর্তীতে ব্যাখ্যা করছি।বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা দিন তিনেক হল সমাপ্ত হয়েছে।যাক্, ক’দিন পড়াশোনা থেকে ছুটি পাওয়া গেল। তার উপর উপড়ি পাওনা দু’দিন পর মা-বাবার সাথে উত্তর বঙ্গের লাভা লোলেগাঁও,রিশপ, দার্জিলিং বেড়াতে যাওয়া,উফ্ কি আনন্দ!এতদিন এত পড়াশোনার পরে অবশেষে ঘুরতে যাওয়ার অবকাশ পাওয়া গেল। আমার দিদা অবশ্য বললেন “তোরা যাবি,কিন্তু টিভিতে কী একটা করোনা ভাইরাস আক্রমণের কথা বলছে? সে যাই হোক টিকিট যখন কাটা হয়ে গেছে, তখন সাবধানে ঘুরেই আয়।”আমরা বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ রাতদিন তো কত কিছুই কাণ্ড হচ্ছে চারিদিকে কিন্তু তার জন্য কি ঘুরতে যাব না এরকম হয়? তাছাড়া মাস্ক পড়ব,স্যানিটাইজার ব্যবহার করব,তাহলেই তো আর কোনো সমস্যা হবে না।”পাঁচ-ছয়দিন আনন্দ করে ঘুরেও এলাম,কোনো সমস্যা হয়নি। একরাশ আনন্দ নিয়ে আসার পর এবার দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলাম বার্ষিক মূল্যায়ন পত্রের জন্যে। আকস্মিক প্রধানমন্ত্রী মহাশয় ঘোষণা করলেন সারা দেশ জুড়ে “লকডাউন”১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত। দেশে অতিমারী শুরু হয়েছে, মানুষ কিছুদিন ঘর বন্দি থাকলে একজনের থেকে অন্য জনের মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারবে না। সমস্ত দোকান, বাজার, যানবাহন, প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ। এই রোগের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি ডাক্তার বাবুদেরও অজানা।বার্ষিক মূল্যায়ন পত্র আর বিদ্যালয়ে আনতে যাওয়া হল না,ই-মেল এর মাধ্যমে পেলাম। অষ্টম শ্রেণীতে যাওয়ার অনুমতি পত্র তো পেলাম, বিদ্যালয় শুরু হবে কবে?প্রথমে ভাবলাম ৬ই অথবা ৭ই এপ্রিল তো শুরু হয় প্রতিবছর, এইবছর হয় তো আর কয়েকদিন পর থেকে শুরু হবে,একটু বেশি ছুটি পাওয়া গেল। অবস্থার অবনতি ক্রমশ হতে থাকায় “লকডাউন” কিন্তু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগল। অবশেষে বিদ্যালয় থেকে জানানো হল বাড়ি থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পঠনপাঠন আপাতত শুরু হবে।বিদ্যালয়ের প্রতি শ্রেণীর প্রতি বিভাগের জন্য হোয়াটাস্ অ্যাপ গ্রুপ তৈরি হল,সময় সারণীও পাঠানো হল।প্রতিদিন চার-পাঁচটা করে ক্লাস এবং মাঝখানে ১০মিনিট করে বিরতি। কি যেন একটা আজব ব্যাপার মনে হচ্ছিল। বন্ধুদের দেখতে পাবো না অথচ ক্লাস করব।কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার এটা মনে হল কদিন বা ক’মাসের ব্যাপার তো।

অনলাইন ক্লাস শুরু হল নির্ধারিত সময় অনুযায়ী। প্রথম দিনই অনলাইন ক্লাস আর অফলাইন ক্লাসের পার্থক্যটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে ভাল করে কথা বলা যায় না,চুপ করে একা শুধু ঘরে দরজা বন্ধ করে ক্লাস করতে হয়।সামনাসামনি শিক্ষক-শিক্ষিকার পড়ানো বিষয় শোনা,ক্লাস রুমের পরিবেশ, বাড়িতে ঠিক যেন সেরকমটা কিছুতেই হচ্ছে না।প্রথম প্রথম সবারিরই অনেক অসুবিধা হচ্ছিল। ঠিকঠাক কানেকশন না থাকলে কিছুই শোনা যায় না।শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছেও পাঠদানের এই প্রক্রিয়াটি নতুন।তারাও অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিভিন্ন ভাবে আমাদের কাছে বিষয় বস্তুর সঠিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। আমরাও অনেক চেষ্টা করে বিষয়গুলি আয়‌ত্ত করার প্রচেষ্টা করতে লাগলাম।এরকম করেই দু’মাস,তিনবার,ছয়মাস অতিবাহিত হতে লাগল, লকডাউন আর কমে না।বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেশকে যেন গ্রাস করেছে।চারিদিকে হাজারো হাজারো মানুষ অসুস্থ, মৃত্যু মিছিল শুরু হয়েছে যেন, আতঙ্কে, ভয়ে, দিন কাটছে সবার। বন্ধুদের সাথে কয়েকদিন পরেই দেখা হওয়ার যে ক্ষীণ আশাটি ছিল সেটা এবার আস্তে আস্তে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগল। আমি ভীষণভাবে বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারটির অভাববোধ করতে লাগলাম। কত নতুন নতুন বই পড়ার ইচ্ছা জাগল মনে কিন্তু সেখানে গিয়ে খোঁজার উপায় নেই। ভার্চুয়াল মাধ্যমের জীবনযাপনে যেন কম্পিউটারের মতো নিষ্প্রাণ হয়ে উঠছি। এক এক সময় কিছুই ভাল লাগে না, কিছুতেই মন বসে না,কিছু করতে গেলে সব ভুল হয়ে যাচ্ছে। কাউকে নিজের মানসিক অবসাদের কথা বর্ণনা করতে পারছি না।বাড়িতে অভিভাবকরাও পর্যন্ত ঘর বন্দি হয়ে,কিছু সময় আমার মতোই তারাও অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ছে।বন্ধুদের অভাব প্রতি পদে অনুভব করছি, পুরোনো ফেলে আসা দিন গুলোর স্মৃতি, ক্লাস রুমের স্মৃতি, মনের কথা বলার বন্ধুর স্মৃতি, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের স্মৃতি, একটি ক্লাসের শেষ ও পরবর্তী ক্লাসের শুরুর মাঝের ক্ষণিক বিরতির মাঝেও বন্ধুদের সাথে মজার দিনগুলি আজ শুধু স্মৃতি আর স্মৃতি। সামান্য বিষয়েই অভিমান হচ্ছে ভীষণ, অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষাও ঘরে বসে অনলাইনেই হল।সেখানেও বিস্তর পার্থক্য, ক্লাস রুমে শিক্ষক-শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপস্থিতিতে, বন্ধুদের সাথে বসে পরীক্ষা দেওয়ার যে অনুভূতি, নিজের মনের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার যে সুযোগ তার কোনো অনুভূতিই ঘটল না। ফলও পেলাম ই-মেলে,খুব একটা ভাল করতে পারিনি।অভিভাবকদের কাছ থেকে সান্ত্বনার বাণী শুনলেও মনমতো ফল না হওয়ার কোনো সঠিক কারণ বুঝতে পারলাম না,মেনে নিতে হল।শুধু মনে হল নিজেকে নিজের মনকে ভালো রাখার চেষ্টা করতে হবে।অত্যন্ত নিরস, একঘেয়ে জীবনের মধ্যে থেকেও আনন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছি।বাড়ির কোণায় যত বই ছিল সব পেরে পেরে পড়তে লাগলাম। ইন্টারনেটের সাহায্যে নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। পুজোর সময় বাবা যখন নতুন ল্যাপটপ কিনে দিয়েছিল তখন আমার আনন্দ আর ধরে না।সেটাতেই বেশি করে সময় কাটাতে লাগলাম। পৃথিবীর সব মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য আকুল হয়ে উঠছে। বিজ্ঞানীরা তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে মানুষকে বন্দি দশা থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।ভারতের ভারত বায়োটেক ও সিরাম ইনস্টিটিউট বিশ্বের মধ্যে প্রথম ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে বিশ্বের দরবারে ভারতকে সম্মানীয় স্থানে প্রতিষ্ঠা করেছে।ভারতীয় হিসাবে এটা আমার কাছে কম গর্বের বিষয় নয়।এইভাবেই অষ্টম শ্রেণীর পাঠ শেষ করলাম। নবম শ্রেণীর পাঠ শুরু হল। নতুন বছরেও সেই নিরস পুনরাবৃত্তি। এখন কোভিড ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে তবে ১৮ বছরের উর্ধ্বদের।১৮বছরের নিচে কেউই নিতে পারবে না। সুতরাং বিদ্যালয় অনলাইনেই চলছে।

একটি চিন্তা আমাকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করে,আমার বা আমার বন্ধুদের পরিবারের সামর্থ্য আছে এই অনলাইন পঠনপাঠনের সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদানের। কিন্তু আমাদের ভারতবর্ষের মতো গরীব দেশের অধিকাংশ অভিভাবকরাই তো অপারগ তাদের সন্তানদের এই সুযোগ নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগান দিতে।সুতরাং তারা তো সম্পূর্ণভাবেই আজ প্রায় দেড় বছর পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে কেউ বা আর্থিক অনটনে কাজে যোগদান করতে বাধ্য হচ্ছে, তো কেউ খেলে বেড়াচ্ছে যার সুদূর প্রসারী ফল হয়ত মারাত্মক হতে পারে।

একটা সমাজকে, একটি সভ্যতাকে অগ্রগতির শিখরে পৌঁছে দেয় তার ছাত্র সমাজ। যেখানে ছাত্রসমাজের অগ্রগতিই থমকে যায়, তাদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয় সেখানে এই সভ্যতার অগ্রগতিও কি থমকে যাবে না?এই বিকাশের প্রতিবন্ধকতাকে বিনাশ করে সমাজ কি পারবে তাদের অগ্রগতির মূলস্রোত পুনরায় ফিরিয়ে আনতে?আজ হয়ত আমাদের ছাত্রসমাজের কাছে এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমরা সুকান্ত ভট্টাচার্য মহাশয়ের দুর্নিবার আঠারো বছর বয়সের সম্মুখীন, আমরা পারবই সব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে, ছাত্রসমাজের দীপ্তমান উজ্জ্বল্যে সমাজকে ভরিয়ে তুলতে,অন্ধকার মুক্ত পৃথিবী গড়তে।

1

Arindrajit Das, Garden High School

I believe that im a student of nature forever, trying to decipher the simple yet elegant rules by which she works. I also like programming and learning about electronics. I enjoy reading a lot.

View All Authors >>

One thought on “অতিমারী ও ছাত্রসমাজ”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 4 =

Supported by:

skgf
skgf

Editor's Picks

Archive

Select a month to view the archive.

Back to Top