‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি’
-‘আমরা’ -সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
ভূমিকা: পৃথিবীতে মানুষের বিচরণ যেমন বহুকালের, সংক্রামক রোগের মহামারীর ইতিহাসও সেরকম অনেক প্রাচীন। অবশ্য মহামারী ও অতিমারীর মধ্যে পার্থক্য আছে।একটি সংক্রামক রোগ যখন একটি জনগোষ্ঠী বা অঞ্চল থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন তাকে মহামারী বলে আর ওপর দিকে অতিমারী হল এই মহামারীর প্রাদুর্ভাব যখন সেটা জনগোষ্ঠী বা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ না থেকে আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে অল্প সময়ে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্বব্যাপী লোককে প্রভাবিত করে।
অতিমারীর ইতিহাস: সেই আদিকাল থেকে মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে ভয়ংকর মারণ ক্ষমতা সহ অতিক্ষুদ্র ‘ভাইরাস’।বর্তমান সময়েব় নিকটতম অতীতের সব থেকে ভয়াবহ মহামারীর হল এইচ-ওয়ান-এন-ওয়ান ভাইরাস দিয়ে ঘটিত ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ যাকে বলা হয় ‘দা মাদার অফ অল প্যানডেমিকস্’ । মেক্সিকোতে উৎপত্তি হওয়া ২00৯ সালের সোয়াইন ফ্লু অতিমারী যা ৭৪টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে আর বহু মানুষ এ-তে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান। এছাড়া কোটি কোটি মানুষ এডস্ এ আক্রান্ত হয়। ২00২-২00৩ সালে সারস্, ২0১৪ সালের ইবোলা জ্বর প্রসঙ্গত উল্লেখ্য। অতি প্রাচীন কালের কয়েকটি মহামারী যেমন প্লেগ, ব্ল্যাক ডেথ, কুষ্ঠ, কলেরা,পোলিও- পৃথিবীতে অগণিত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
‘কোভিড-১৯’-র সূত্রপাত: বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী মানবসভ্যতার উপর যে বিভীষিকাময় খড়্গটি নেমে এসেছে,সেটা হল ‘কোভিড-১৯’। প্রায় বছর দুই ধরে এই দানবটাকে মোকাবিলা করার জন্য হিমশিম খাচ্ছে গোটা বিশ্ব।এত ক্ষুদ্র অস্তিত্বের এমন ভয়াল থাবা বর্তমান পৃথিবীর কোনো মানুষ জীবদ্দশায় দেখেনি।করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে ২0২0 সালের ১১ই মার্চে WHO একটি ‘বৈশ্বিকমহামারী’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। চিকিৎসা বিঞ্জানীদের অনুমান ২0১৯ সালের ডিসেম্বরর চিনের উহান শহর থেকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ অতি-দ্রুত সমগ্রবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। করোনা ভাইরাস আক্রান্ত একজন রোগীর দেহে ২-১৪ দিনের মধ্যে সাধারণত যে সমস্ত লক্ষণ দে্খা যায়, তা হল- জ্বর, মাথাব্যথা,সর্দি, কাশি,গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, গায়ে ব্যথা, ক্লান্তি- ইত্যাদি। যেসব স্বাস্থ্যবিধি সকলকে মেনে চলতে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে, সেগুলি হল- মাস্ক পড়া, সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করা এবং একটা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা।
করোনার প্রভাব: পৃথিবী আজ থমকে গেছে। বিশ্বের প্রায় সমস্ত মানুষ গৃহবন্দী। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এই রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। তাই প্রতিরোধের উপায় হিসেবে সমস্ত দেশেই পালিত হচ্ছে লকডাউন। যার ফলে সামাজিক থেকে অর্থনৈতিক জীবন আজ বিপন্ন, প্রান্তিক মানুষ থেকে অভিজাত শ্রেণী, শিশু থেকে বয়স্ক বিশেষত ছাত্রজীবন বিশেষভাবে বিপর্যস্ত।
শিক্ষা-ব্যবস্থা যাতে থমকে না দাঁড়ায় তার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন শ্রেণী অনুযায়ী পর্যায় মূল্যায়ন মডেল- অ্যাক্টিভিটি টাস্ক, ক্লাস টেস্ট, অ্যাসাইনমেন্ট, ইত্যাদির মাধ্যমে পড়াশোনার, ক্ষতিও পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই শিক্ষা-ব্যবস্থা কতটা কার্যকর- তাও বিবেচনার দাবি রাখে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ যখন এই ভাইরাসের
প্রভাবে বিপর্যস্ত, তখন সবদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও ছাত্রসমাজের প্রায় একই অবস্থা স্বাভাবিকভাবে। উন্নত কিংবা অনুণ্ণত দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থা এই ভাইরাসের দুর্দান্ত প্রকোপে সমানভবে ক্ষতিগ্রস্থ।
সব দেশ সমানভাবে বিপর্যস্ত হলেও, এই ক্ষতিপূরণ করতে উন্নত দেশগুলির সামর্থ্য তুলনামূলকভাবে বেশি। তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও মেধার সম্মীলন- এই দুরবস্থা অনেকটাই কাটিয়ে তুলবে।কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলি একেবারে নাজেহাল। শুধু অর্থ আর প্রযুক্তির অভাবই নয়, তাদের পশ্চাৎপদ মানসিকতাও অনেকাংশে দায়ী। সাধারণ ও সামর্থহীন ঘরের অনেক পড়ুয়ারা এই সংকটকালে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে।
শিক্ষাব্যবস্থা ও ছাত্রসমাজে করোনার প্রভাব: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ, তবুও অনলাইন ক্লাস, অনলাইন টেস্টস্, ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রক্রিয়াকে চলমান রাখার এই ফলাফলকে, অনেকেই সমালোচনা করে বলেছেন- দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। তাদের মতে ক্লাসরুমের শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের মধ্যে যে স্বাভাবিকভাবে ও স্বতঃস্ফুর্ততা থাকে তা অনলাইনে সম্ভব নয়। একথা আমরা সবাই বুঝি, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীরা তা উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও থেমে গেলে চলবে না- এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে, শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে গেলে ঘুরে দাঁড়ানো মুশকিল হয়ে পড়বে।
ঘরবন্দী শিক্ষার্থীরা এককথায় দিশেহারা। সব শিক্ষার্থীর সমস্যা একরকম নয়। শিক্ষিত পরিবারের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের, শিক্ষার ব্যাপারে যত্ন নিতে পারেন কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ দিতে পারেন না যা ক্রমশ তাদের সন্তানদের মনের ওপর প্রভাব ফেলে। আবার গরিব পরিবারের শিক্ষার্থীরা, যাদের কাছে মোবাইল ফোন হাতে থাকা দিবাস্বপ্নের মতো, তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। তারা বাধ্য হচ্ছে শিক্ষা থেকে অব্যাহতি নিতে। ধীরে ধীরে তারা মানসিকগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বোর্ডের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল হবার সিদ্ধান্ত। প্রথম সারির শিক্ষার্থীরা চূড়ান্ত প্রস্তুতির পরেও, লড়াইয়ের ময়দানে নেমে স্বীয়োপ্রতিভা দেখাতে পারলো না। বর্তমানে ক্রমশ শিক্ষার্থীর কাছে সব ধরণের মূল্যায়নই মূল্যহীন হয়ে উঠছে।
মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে, ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার অনেক ছাত্রছাত্রীরা সামাজিক মাধ্যমে কিংবা ‘ভিডিও গেমে’ নেশাগ্রস্ত হয়ে তাদের জীবনকে সর্বনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকরা তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে প্রতিফল স্বরূপ তারা রূঢ় হয়ে যাচ্ছে। এতে তারা ধীরে ধীরে হতাশার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।
ছাত্রসমাজের অবদান: পৃথিবীর ইতিহাস বলছে, বিশ্বের সকল ক্রান্তিকাল, মহামারী, দুর্যোগ, বন্যা, খরা, যুদ্ধ, বিগ্রহকালে ছাত্রসমাজ ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে। ছাত্রসমাজ হল প্রাণশক্তিতে ভরপুর।
‘এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য।’
-‘আঠারো বছর বয়স ’- সুকান্ত ভট্টাচার্য
তাই সমাজের জন্য, দেশের জন্য এহেন দুর্দিনে সেবামূলক মানসিকতা নিয়ে ছাত্রসমাজের এগিয়ে আসা আবশ্যক। সরকারি উদ্যোগে সমস্ত বিধি মেনে সেবামূলক কাজে ছাত্রছাত্রীদের নিয়োগ করা উচিত। যেমন-
o সচেতনতা মূলক শিবির, সচেতনতা মূলক সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা
o মাস্ক, স্যানিটাইজার বিতরণ কেন্দ্র
o স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা
o টীকাকরণের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান
o শ্লোগান, অঙ্কনের উপর পোস্টারিং জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং জনজাগরণের চেষ্টা
এমন কর্মসূচীর মাধ্যমে ছাত্রজীবনের অবসাদ কাটবে এবং সাধারণ মানুষও উপকৃত হবে।
উপসংহার: উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ‘ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট’ অনেক বেশি সংক্রামক, অনেক দ্রুত বেশি সংখ্যক মানুষের উপর প্রভাব ফেলতে পারে করোনা ভাইরাসের তৃতীয় ঢেউ। তারপরও বলতে চাই- পৃথিবীতে সমস্ত মহামারী শেষ হয়েছে, এটাও শেষ হবে। তাই বিঞ্জানসম্মত স্বাস্থ্যবিধির উপর আস্থা রেখে, মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছার উপর ভরসা রেখে আমরা অবশ্যই কোভিডকে বিদায় দিয়ে স্বাভাবিক জনজীবনে আবার ফিরে আসতে পারব।
“আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে,
আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে।
আমাদের দেখা হোক জীবাণু ঘুমালে,
আমাদের দেখা হোক সবুজ সকালে।”
– ‘শঙ্খচিল’- জীবনান্দ দাশ