“অতিমারী” এমন একটি শব্দ যার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে রয়েছে ভয়, আতঙ্ক, ও সাহায্যের জন্য অসহায় মানুষের করুণ হাহাকাররব। মানুষ জীব জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণী। সভ্যতার শীর্ষে পৌঁছে আজ মানুষ অসম্ভবকে সম্ভবপর করে তুলতে পেরেছে। গত শতকের চন্দ্রাভিযান, পরমাণুতত্ত্ব আবিষ্কার, চিকিৎসাশাস্ত্রে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার, প্রভৃতি তার উদাহরণ। তবে চিরকালই মানবজাতিকে ক্ষুদ্র জীবাণুদ্বারা সংক্রমিত কিছু মহামারীর সঙ্গে মোকাবিলা করতে গিয়ে মরণপণ সংগ্রামে যোগ দিতে হয়েছে। তার বিনিময়ে হারাতে হয়েছে অজস্র প্রাণ। ইতিহাসের পাতায় যেসব অতিমারীর নাম কালিমালিপ্ত হয়ে থেকে গিয়ে আজও আমাদের মনে ভীতির সঞ্চার করে, তাদের মধ্যে অন্যতম কালা জ্বর, প্লেগ, ১৯১৮-এর স্প্যানিশ ফ্লু, ১৯৮০-র দশকের এডস অতিমারী, প্রভৃতি। মানুষ প্রতিটি মহামারী থেকেই কিছু-না-কিছু শিক্ষা পেয়েছে। “কোয়ার্যান্টিন” বা পৃথকীকরণ পদ্ধতি, শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখা, ভ্যাক্সিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার, ইত্যাদি মানব সভ্যতাকে অগ্রগতির পথে চালিত করতে সাহায্য করেছে।
বৈজ্ঞানিক প্রসারের ফলে আধুনিক যুগে অতিমারীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেশ কম। কিন্ত আজও মাঝেমাঝে পৃথিবীর কোলে আছড়ে পড়ে ধ্বংস, সর্বনাশ, মৃত্যুর প্রতীক- সর্বগ্রাসী “অতিমারী”। এক অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে যেন চলতে থাকে আমাদের যুদ্ধ। আমরা বর্তমান পরিস্থিতিতে এইরকমই এক অতিমারীর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। বহু নিরীহ মানুষ তার মারণ-দংশন থেকে আত্মরক্ষা করতে না পেরে বাধ্য হয়েছেন তার কৃষ্ণগহ্বরের অতল পাদদেশে নিজেদের সমর্পণ করে দিতে।
এই অতিমারী পরিস্থিতিতে সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত যারা, তাদের মধ্যে অন্যতম, ছাত্র-ছাত্রী। সমস্ত স্কুল, কলেজ এখন বন্ধ। ঘরবন্দি হয়েই “অনলাইন” মাধ্যমে চালিয়ে যেতে হচ্ছে লেখাপড়া। আজ মোবাইল, ল্যাপটপ ঘরে-ঘরে নিতান্তই সহজলভ্য। কিন্তু সত্যই কি ঘরে-ঘরে প্রতিটি পড়ুয়া অবলম্বন করতে পেরেছে ‘অনলাইন’ মাধ্যমে নতুন শিক্ষারীতি? ভারতবর্ষের মতো কোনও উন্নতির পথে আগ্রগামী জনবহুল দেশে তা অসম্ভব! গত এক বছরে আমদের দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কত হাজার-হাজার ছাত্র-ছাত্রীর যে কী অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে সারা জীবনের মতো! কত আশা, প্রত্যাশা, বহু-আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের জাল -তারা এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও মনের অন্তরালে বুনত ও এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখত। কিন্তু হায়! মাঝে এ কী অযাচিত, অবাঞ্ছনীয় বিঘ্ন!
তারা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। তাদের বেশিরভাগেরই বাবা-মা হয় মাঠে কৃষি কাজ করেন, কিংবা কোনও কারখানার দৈনিক মজুর। লকডাউনে এ-দুটিই বন্ধ। অতএব দৈনিক রোজগারের উপায়? এই ক্ষুদে পড়ুয়ারা তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে বাড়ি-ঘর-খেলাধুলো ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে রাস্তায়-ফল, সবজি, আনাজ বিক্রি করতে। আর লেখাপড়া? সে যে শুধুমাত্র ধনী ছেলেপিলেদের ‘বিলাসিতা’! তবে, শহরে এ দৃশ্য পালটে যায়। সেখানে অনলাইন মাধ্যমে পুরোদমেই চলছে পড়াশোনা। পরীক্ষাও নেওয়া হচ্ছে সময়মতো। শুধু বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাসের মাঝের বিরতি- সময়ে মাঠে একসঙ্গে হই-হট্টগোল, খেলাধুলোটাই যা সম্ভব হচ্ছে না; ফোনে-ফোনে কথা আর ভিডিওকলের মধ্যেই শুধু পরস্পরকে তারা দেখতে পায় মাঝেমাঝে।
কিন্তু বন্ধু-সহপাঠী-শিক্ষক-শিক্ষিকাদের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে আর কতদিন তারা এইভাবে দিন কাটাবে? প্রত্যেকের মনেই এই অনিশ্চয়তা। অভিভাবকদের চিন্তা, সর্বক্ষণ কম্পিউটরের সামনে বসে তাদের শারীরিক ব্যাধি, বিশেষ করে চোখের দৃষ্টিতে সমস্যা না দেখা দেয়। কিন্ত আরও বড় যে চিন্তার বিষয়, তা হল, এই নতুন আবহাওয়ায় শিশুরা কি তাদের ছেলেবেলার আনন্দ হারিয়ে ফেলছে না? হারাচ্ছে না কি তারা, সেই শৈশবের দুষ্টুমি, স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে বকুনি শোনা, বন্ধুদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা-সুখ-দুঃখের মুহূর্তগুলি-যা আমাদের বড় হয়ে ‘মানুষ’ হতে সাহায্য করে। পড়ুয়ারা কি অসামাজিক, অনালাপীও হয়ে উঠছে না? আমাদের কাছে আছে হোয়াটস্যাপ, ফেসবুক-সেগুলিও তো সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই সমাজের সঙ্গে আমদের যোগাযোগ স্থাপন করার উপায়। কিন্তু মানুষ আর যন্ত্রের মধ্যে তো বরাবরই পার্থক্য রয়েছে! প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করে কুশল জিগ্যাসাটুকুও যদি আমরা না করে ‘চ্যাট’-এ মেসেজ পাঠাই; হাতে হাত না মিলিয়ে কম্পিউটরে-স্ক্রিনে ‘এমোজি’ দেখি; কখনো সামনাসামনি না দেখে শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে যে শ্রদ্ধা, ভালোবাসার নিগূঢ় বন্ধন তৈরি হয়, তা থেকে বঞ্চিত হই ও বন্ধুবান্ধবদের হৃদয়ের মিলন অবশেষে শুষ্ক যান্ত্রিক মাধ্যমের সাহায্যে সম্ভবপর হয়, তাহলে অবশ্যই জীবনে একঘেয়েমি এবং বৈচিত্র্যের চরম সঙ্কট দেখা দেবে। পড়াশোনার এই নতুন মাধ্যমের সঙ্গে অভ্যস্ত হতেও বেগ পেতে হয়েছে অনেককেই।
কিন্তু এ তো হল অতিমারীর অবাঞ্ছিত প্রভাবের কথা। এবার আরেক প্রসঙ্গে আসি।
করোনা অতিমারিতে যখন একের পর এক অসহায় মানুষ মৃত্যু মিছিলে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছিলেন, যখন অজস্র রোগী হাসপাতালের বিছানায় গভীর মারণ-যন্ত্রণার মধ্যে দিনযাপন করছিলেন, তখন খোঁজ মিলেছিল কিছু নবীন ছাত্র-ছাত্রীর যারা সমস্ত বাধা-বিঘ্ন উপেক্ষা করে এগিয়ে এসেছিল সাধারণের সুরক্ষার কিছু অভিনব পরিকল্পনা নিয়ে। তাদের বয়স কম; অভিজ্ঞতাও সামান্য। কিন্তু তাদের রয়েছে অসম্ভব মনের জোর, অসামান্য আত্মবিশ্বাস। তাদের বয়স স্বল্প বলেই বোধহয় কোনও দুঃসাহসিক, আপাতদৃষ্টিতে দুরূহ কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়িত করার এক অদম্য ইচ্ছা মনের ভিতর কাজ করে। করোনা অতিমারী এই ধরনেরই কিছু পড়ুয়াদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়েছে, যারা দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়ে দেশ-বিদেশের সীমান্ত উপেক্ষা করে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে আর্ত-পীড়িত মানুষের সাহায্য করেছে। উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেওয়া প্রবাসীরা পাঠিয়েছে দেশে অর্থ, কেউ চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রসার ঘটিয়ে যথাসম্ভব উন্নতি এনেছে, অথবা কেউ শুধুমাত্র রাস্তায় দলবদ্ধ হয়ে নেমে সংক্রমণ রুখতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করেছে মাস্ক, স্যানিটাইজার, ইত্যাদি। করোনা মোকাবিলায় যেসব নিঃস্বার্থ ছাত্র-ছাত্রীরা সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম নয়।
তাদের মধ্যেই একজন দিল্লিবাসী সার্থক জৈন-একাদশ শ্রেণির ছাত্র। তার আবিষ্কার একটি ‘ডোরবেল’-যা কোনওরকম স্পর্শ ছাড়াই পঞ্চাশ সেন্টিমিটারের মধ্যে যেকোনো ব্যক্তির উপস্থিতি টের পেয়ে নিজের থেকেই জানান দেবে। ফলে, ডোরবেলের মতো সংক্রমণপ্রবণ কোনও বস্তুর গায়ে হাত না লাগিয়েই আগন্তুকের আনাগোনা চলতে পারে। আর এক ক্ষুদে পড়ুয়া, নবম শ্রেণির শিবম মুখার্জি; তার আবিষ্কার- একটি ‘অ্যাপ’-চালিত ‘স্যানিটাইজিং ব্যান্ড’ যা হাতের কব্জিতে পরে কোনও বস্তুর কাছে এলেই আপনা থেকেই ‘ইউ.ভি.’ আলোকরশ্মি ও অ্যালকোহলের দ্বারা জায়গাটি জীবাণুমুক্ত করা যাবে। হরিয়াণা থেকে দুই ভাই এসেছে এক অভিনব পদ্ধতিতে তৈরি ‘পোর্টেবল ভেন্টিলেটর’-এর পরিকল্পনা নিয়ে। সাধারণ কাঠের তৈরি কাঠামোয় একটি গোলাকৃতি ‘বল’ লাগানো রয়েছে, যা একটি মোটরের সঙ্গে সংযুক্ত। বিদ্যুতচালিত এই ‘বল’ প্রয়োজন মতো পাম্প করা শুরু করে অক্সিজেনে ভরতি হয়ে যায়। ফলে, বিদ্যুতচালিত এই ‘বল’ প্রয়োজন মতো পাম্প করা শুরু করে অক্সিজেনে ভরতি হয়ে যায়। ফলে, কম সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন কোভিড রোগীদের দেহে সঞ্চালিত করা যায়। ভেন্টিলেটরের এই নতুন প্রক্রিয়া শহরের হাসপাতালে পরীক্ষা করে সুফল মিলেছে। উদ্যোগকারী দুই ভাই মাত্র চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র! নিতান্তই স্বল্পবয়সী এই পড়ুয়ারা যে সমস্ত অভিনব পরিকল্পনা নিয়ে সাধারণের সুরক্ষায় নিয়োজিত হয়েছে, তা সত্যই চিত্তাকর্ষক।
আসলে লকডাউন আমদের মতো সকল ছাত্র-ছাত্রীরই জীবনে প্রভাব এনেছে, কম সময়ে কিছু প্রভাব এনেছে, তা যত সামান্যই হোক। কেউ শিখেছে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের তাদের সঙ্গে বেশি সময় কাটিয়ে তাদের ভালো করে চিনতে; কেউ খুঁজে পেয়েছে কোনও নতুন শখ-তার নতুন রুচি বা প্রবণতা; কেউ পড়াশোনার এই নতুন মাধ্যমে সুফল লাভ করেছে, আবার কারো ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক এর বিপরীত।
শৈশব যেন সূর্যোদয়ের মতো। দিনের সুচনালগ্নে যেমন সারা আকাশ লাল আলোক-ছটায় বিকশিত হয়, তেমনই আমাদের প্রত্যেকের শৈশবের কিছু স্মৃতি মনের গহ্বরে সুরক্ষিত থেকে যায়, সারা জীবনের মতো। এই অভিজ্ঞতাগুলিই আমাদের পরবর্তীকালে ‘মানুষ’ হতে সাহায্য করে, সাহায্য করে একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের মর্যাদা পেতে। মনে পড়ে যায় কবির গানের লাইনঃ ‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসি’। দিনের পর দিন অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে আসবে নানান বাধা-বিপত্তি; করোনা অতিমারী এরই একটি। আমরা, দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যাদের ওপর নির্ভর করে, তারা এত সহজে দমবার নই। আমরা বিপুল এই তরঙ্গের সঙ্গে হেসে খেলে জীবন-নদের স্রতে ভেসে বেড়াব আজীবন; আমরা স্বাধীন-মনে প্রাণে; এ-যুদ্ধে জয়ী আমাদের হতেই হবে। নবপ্রজন্মের এই প্রার্থনা, যেন এই বিপর্যয় অবিলম্বে সমাপ্ত হয়, ও আমরা ফিরে আসতে পারি স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ টাইমস অফ ইন্ডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা, ইন্ডিয়া টাইমস]