ভূমিকা : যেদিন পৃথিবী সৃষ্টি হয়, তার বহু বছর পর সেখানে মানুষের জন্ম হয়। সে সেদিন পেয়েছিল সবচেয়ে পবিত্র জল এবং বিশুদ্ধ বাতাস। পরিবেশ তখন ছিল সবথেকে সুন্দর। মানুষ তো বটেই, গাছপালা, পশু-পাখি এদের কাছেও পরিবেশ মায়ের মত। আমাদের আবির্ভাব হওয়ার পর থেকেই আমরা পরিবেশ মায়ের কোলে পালিত হই জল, বায়ু এবং আলোর অকৃপণ দানে। আমাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়ে ওঠে অটুট। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানবজাতি সভ্য হয়ে ওঠে এবং যন্ত্রসভ্যতার উন্নতি ঘটায়। সে উন্নতিতে আমাদের সুখ, স্বার্থ আর স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি পেয়েছে বটে কিন্তু সাথে সাথে বায়ুমন্ডল এবং পরিবেশ দূষিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন ধরণের দূষণের জন্ম দিয়েছি আমরাই।
পরিবেশ দূষণের কারণ : পরিবেশ দূষণের মূলে সবথেকে বড়ো যে কারণটি রয়েছে সেটি হল প্রতিনিয়ত রাস্তায় চলাচল করা অজস্র যন্ত্রচালিত যানবাহন। যেগুলি বাতাসে মিশিয়ে চলেছে ক্ষতিকারক গ্যাস। অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড এবং সালফার বাতাসকে দূষিত করে তুলছে। বৃক্ষ ধ্বংস হওয়ার ফলে মানুষ শস্য-শ্যামলা সুন্দর পরিবেশের সৌন্দর্য থেকেই শুধু বঞ্চিত হচ্ছে তাই নয়, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অরণ্যের ভারসাম্যও। আর এর কারণ হল প্রতিনিয়ত নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদন। শহর, রাস্তাঘাট, আবাসন এমনকি আবাদি জমি নির্মাণের জন্য যা আমরা করে চলেছি। ফলস্বরূপ আমরা নানা ধরণের রোগে আক্রান্ত হচ্ছি, বিশেষ করে ফুসফুসের। এর পর আসে জলদূষণ। এর জন্য মূলতঃ দায়ী কল-কারখানাগুলি। এখানে যেসব বর্জ্য পদার্থগুলি তৈরি হয় সেগুলি নদীতে গিয়ে পড়ে তাকে দূষিত ও আমাদের ব্যবহারের অযোগ্য করে তুলছে। বিশেষ করে গ্রাম্য অঞ্চলগুলিতে একই পুকুরের জলে স্নান, কাপড় কাচা সব একসাথে হয়। এর জন্যেও দেখা দেয় নানা রোগব্যধি। অপর এক দূষণ হল শব্দদূষণ। যে দূষণ শহর ও গ্রাম উভয় জায়গাতেই মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি করে থাকে। বর্তমান আধুনিক সভ্যতার অংশ হিসাবে বিভিন্ন কলকারখানার শব্দ, যানবাহনের শব্দ, উৎসব-অনুষ্ঠানে বাজানো মাইক বা বক্স ইত্যাদির শব্দ হল এর প্রধান উৎস। এর ফলে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পায় এমনিকি বধিরতা পর্যন্ত তৈরি হয়। ক্ষেত্রবিশেষে বয়স্ক অসুস্থ মানুষের ক্ষেত্রেও যা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।
পরিবেশ সংরক্ষণ কিভাবে করব : আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ আছে কিন্তু তার কোনটাই অফুরন্ত নয়। বিভিন্ন খনিজ সম্পদের সাথে বায়ু, জল, মাটি, বন, বন্যপ্রাণি সবই হল প্রাকৃতিক সম্পদ। এই অমূল্য সম্পদ নিয়ত অপচয় ও যথেচ্ছ ব্যবহারের জন্য আমরা পরছি নানা সমস্যার মুখে। জীবগোষ্ঠীর সার্বিক মঙ্গলের জন্য এই প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ করা, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা, পুনরুদ্ধার এবং সীমিত ব্যবহার নিশ্চিত করাকে সংরক্ষণ বলে। এর গুরুত্ব এবং পদ্ধতিও অনেক। বর্তমান সময়ের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল অরণ্যধ্বংস। যে কারণে বনের পশু-পাখিরা ঠিকমত নিজেদের খাবারের সংস্থান করতে পারছে না, নিজেদের বাসস্থান হারাচ্ছে। অন্যদিকে আবার চোরা শিকারীরা অর্থের লোভে পশুপাখিদের শিং, চামড়া, দাঁত, পালক ইত্যাদি সংগ্রহ করছে বন্যপ্রানীদের হত্যা করে। যে কারণে বেশকিছু বন্যপ্রাণী হয় চিরতরে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে নয় ক্রমশঃ বিলুপ্তির পথে। এই সমস্যার সমাধানে লুপ্তপ্রায় প্রাণীদের বিদেশে পাচার রোধ বা আইণ প্রণয়ন করে শিকার বন্ধ করাই যে একমাত্র পথ নয় এটা বুঝে বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে এসেছেন নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে রেডিও কলার ব্যবহার শুরু করার কথা। বন্যপ্রাণীর শরীরে লাগিয়ে দেওয়া এই যন্ত্র থেকে নির্গত সিগন্যালের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে জীবজন্তুদের গতিবিধি কিংবা অবস্থান সম্পর্কে। আবার অপরদিকে অরণ্য ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে তৈরি করা হয়েছে অনেক জাতীয় উদ্যান বা অভয়ারণ্য। যেখানে বন্যপ্রাণিরা নিজেদের মতো করে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকতে পারে ও নির্ভয়ে বাঁচতে পারে। তবে এর সাথে সাথে জনবিস্ফোরণ ও অনুপ্রবেশের মত বিষয়কেও নিয়ন্ত্রণ করার সুষ্ঠু উদ্যোগ নেওয়া একান্ত জরুরী।
পরিবেশ সংরক্ষণে ভবিষ্যত প্রজন্মের ভূমিকা : পরিবেশকে আরো উন্নত ও সুন্দর করে তুলতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম ও বর্তমান যুগের ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব বা জল, বায়ু বা পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কে নাগরিকদের সচেতন করার জন্য তারা পোষ্টার, ব্যানার ব্যবহার করতে পারে। নিজেরাই সাফাই অভিযানের উদ্যোগ নিয়ে মানুষকে নিজের আশে পাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য উৎসাহিত করতে পারে। নিয়মিত নজরদারীর মাধ্যমে নিজেদের এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখা, পানীয় জলের অপচয় রোধ করা বা অপর মানুষ জনকে নির্দিষ্ট স্থানেই কেবল আবর্জনা ফেলতে বাধ্য করতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে অপর নাগরিকদের এই কাজে সামিল করতে বা দায়িত্ব নিতে আগ্রহী করে তুলতে পারে। অতীতে স্বদেশি যুগে তৎকালীন নতুন প্রজন্ম এমন বহু কাজের নিদর্শন আমাদের সামনে রেখে গিয়েছে। সেই ঐতিহ্যের ধারা বজায় রেখে বর্তমান প্রজন্মও যদি কাজ করে চলে তাহলে আমরা অনায়াসেই আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করতে পারব।
উপসংহার : আমাদের এই চিরসবুজ পৃথিবীর টুকরো টুকরো সবুজ পরিবেশগুলির সুস্থতা বজায় রাখবে সবুজ প্রাণে ভরপুর ভবিষ্যত প্রজন্ম। পরিবার, সমাজ এবং নিজেদের একটি সুন্দর, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ উপহার দেওয়ার জ্ন্য যারা অঙ্গীকারবদ্ধ হবে। সাথে সাথে সমাজের সর্বস্তরের, সব বয়সের মানুষেরা তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে এই অমূল্য পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য এই আশায় আমরা যেন বুক বাঁধতে পারি।