“ পৃথিবীর ফুসফুস আজ বিপন্ন। বিশ্বের ২০% অক্সিজেনের আমদানি হওয়া বৃষ্টি-অরণ্য আমাজনকে গ্রাস করছে আগুনের লেলিহান শিখা। ” —আনন্দবাজার পত্রিকা (২৩ আগস্ট, ২০১৯)
হঠাৎ প্রায় দু’বছর আগের একটি প্রতিবেদনের উল্লেখ কেন করলাম তা বলি।
‘পরিবেশ সংরক্ষণ’, প্রথমবার এই উক্তিটির সাথে পরিচয় ঘটে ক্লাস ফাইভের ছোট্ট আমি-র। বইয়ের পাতায় স্পষ্ট লেখা শব্দমালা, “ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ব্যবহারের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ করা দরকার।” তখন, পরীক্ষায় লেখার জন্য পড়ে থাকলেও এর প্রকৃত অর্থ বুঝিনি। বুঝিনি আরও ছোটবেলায়, নাম না জানলেও প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন আমার বাবা। একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে, যেই পরিবেশ ও প্রকৃতিতে আমাদের বেড়ে ওঠা, তার যত্নআত্তি তো আমাদের মতো আগামী প্রজন্মেরই হাতে।
“বাবা, গাছের যে জীবন হয় কই গাছ তো কথা বলে না!”
আমার মত কাঁচা বয়সে সব বিষয়ে কৌতূহল ও জিজ্ঞাস্য থাকে সব কিশোরদেরই। তাই আমার বাবার মতো সব বড়দের দরকার সবে ফুঁটে ওঠা ছোট কুঁড়ির মত কিশোর-কিশোরীদের কাঁচা মনে পরিবেশ ও সবুজের সঞ্চারণ। তবে এখনকার আধুনিক যুগে যখন সব শিশুরাই ফোন হাতে জন্মায়, যখন প্রত্যেকটা নতুন দিন আসলে একটি নতুন জেনারেশন, ছোট ও বড়দের মধ্যে সৃষ্টি হয় জেনারেশন গ্যাপের, তখন শিশুদের নজর কাড়তে সক্ষম একমাত্র প্রকৃতিই। প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্বেতশুভ্র চুড়া, সমুদ্রের ঢেউয়ে দাপিয়ে চলা, গঙ্গায় নৌকা ভ্রমণ, রাজস্থানের মরুভূমিতে উটের পিঠে চড়া, সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অপেক্ষা, আলিপুর চিড়িয়াখানায় বাঘ, ভাল্লুক, কুমির, পাখি দেখে পিকনিক – দাগ কাটে আমার মত প্রত্যেকটা কিশোরের মনে। এই সুযোগেই প্রকৃতি প্রেমের একটা ছোট্ট শিখা দপ করে জ্বলে ওঠে আমাদের গভীরে। আসলে, ভালোবাসার জিনিসটাকে বারবার দেখার, উপভোগ করার তাড়না, আমাদের বাধ্য করে তাকে যত্নে রাখতে। নিজের অজান্তেই আমরা এক ধাপ এগিয়ে যাই পরিবেশ সংরক্ষণের দিকে। আসলে বইয়ের পাতার থিওরির থেকে নিজে এক্সপেরিয়েন্স করা প্র্যাকটিক্যালের দাম তো বেশিই হয়!
‘সংরক্ষণ’ ও ‘পরিরক্ষণ’, এই দুটি শব্দ আমাদের কাছে অনুরূপ ঠেকলেও, তা নয়। প্রথমে যে আমাজন বৃষ্টি অরণ্যের কথা উল্লেখ করেছি, ‘ইউনাইটেড নেশনস’ সহ আরও এমন উদ্যোক্তারা এখন এটাই প্রয়াস করছে যাতে অবশিষ্ট অরণ্যটুকুকে কোনমতে বাঁচিয়ে রাখা যায়, অর্থাৎ তাকে পরিরক্ষন করা যায়। অন্যদিকে, বিশ্ব জুড়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ন্যাশনাল পার্ক, ওয়াইল্ডলাইফ সেঞ্চুরির অদম্য চেষ্টায় গড়ে উঠেছে ‘টাইগার কনজারভেশন ফাউন্ডেশন’ এর মতো বিভিন্ন সংস্থা, যারা সংরক্ষণ করছে ভারতে অবশিষ্ট ২৯৬৭ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার কে। সোজা ভাষায় বলতে গেলে, ‘সংরক্ষণ’, প্রকৃতির প্রয়োজনীয়তা বুঝে, তার যথাযথ ব্যবহারের চেষ্টা করে এবং ‘পরিরক্ষণ’, মানুষের সেই ব্যবহার থেকেই অবশিষ্ট প্রকৃতির সুরক্ষা করে।
শুধু যে উদ্ভিদ ও প্রাণী বাঁচালে প্রকৃতি বাঁচবে, তা নয়। অধিক নগরায়ন, বন উজার, অবৈধ খনিজি ও বন্যজীবের শিকার ক্রমশ ধ্বংস করে চলেছে প্রকৃতিকে। এই সূত্রে বলা যাক, করোনা মহামারীতে লকডাউনে বাড়িতে বসে বলা সেই জনপ্রিয় উক্তিটি,
“ মহামারীতে প্রকৃতি মানুষের নৃশংস শোষণ থেকে ‘বিরতি’ পাচ্ছে।” অনেকের এই কথাটিকে ঠিক মনে হলেও আসলে এটি একটি ভুল ধারণা। কারণ যেই পরিযায়ী শ্রমিকরা শহরে কাজ হারিয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর, তাদের জন্যই প্রকৃতির উপর বাড়ছে চাপ এবং তাল মিলিয়ে বাড়ছে গ্রামে-গঞ্জে কোভিড-১৯ এর আশঙ্কাও। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’ দেখিয়েছে যে প্রকৃতির নিজস্ব সঞ্চালনে মানুষের হস্তক্ষেপে পৃথিবীর স্তন্যপায়ী প্রাণী, উভচর, মাছ, পাখি এবং সরীসৃপের জনসংখ্যা ১৯৭০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ৬৭% হ্রাস পেয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার’ এর মতে বর্তমানে ৩১,০০০ এরও বেশি প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রায় বিলুপ্তির পথে। ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’-এর গণনায়, আমরা যদি বনাঞ্চলের যত্ন না নিই, তবে সেখানে কার্বন ডাই-অক্সাইড নোটার মাত্রা কমে গিয়ে দেখা দেবে অতিরিক্ত বায়ু দূষণ।
আমার স্কুলের প্রিন্সিপাল বলতেন, যে কোনো বিষয়ে আলোচনা করার জন্য প্রয়োজন আলোচ্য বিষয়টির প্রত্যেকটা ভগ্নাংশের সঠিক বিশ্লেষণ। সেই সূত্রে ধরা যাক ‘পরিবেশ’ শব্দটির গুরুত্ব। পরিবেশ মানেই যে গাছপালা-পশুপাখি, তা নয়। একটা শিশু যেই জায়গায় বেড়ে ওঠে, তার দাদু-ঠাম্মি, বাবা-মা, পাড়ার বন্ধুরা, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, দোকানের লজেন্স কাকু, সবাই সেই শিশুটির পরিবেশেরই এক অংশ। তবে স্কুলের পড়াশোনা, প্রজেক্ট, হোমওয়ার্কের চাপে বাচ্চারা দূরে সরে আসে তাদের এই পরিবেশ থেকেই, বন্দী হয়ে যায় বাড়ির চার দেওয়ালে। তখন তার একমাত্র বন্ধু হয়ে ওঠে ফোন; ইউটিউব, মাইনক্রাফট হয়ে ওঠে সম্বল। বড়দের কাছে তাই বকাও খেতে হয় কত। কিন্তু ‘বড়’ মানে বকা বা বাধা দেওয়া নয়, ছোটদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্বও বটে। তাদের বোঝানো যে মাইনক্রাফটে ক্ষেত বানালে পৃথিবী সুন্দর হবে না, বরং দরকার চারা গাছ পুঁতে তাকে রোজ জল দিয়ে বাড়িয়ে তোলা, ধরিত্রীর বুকে একটা গাছের সংখ্যা বাড়ানো। আসলে প্রথম পরিবর্তনের সূচনা হয় তো বাড়ি থেকেই। ভেবে দেখুন, একটা ৮-৯ বছরের বাচ্চা, ‘সংরক্ষণ’ কথাটার মানে না বুঝলেও, আপনি যদি তাকে ১০০ টাকা হাতে গুঁজে বলেন, “ বাবা, এটা তোমার! ” সে কিন্তু খুব যত্নে সেটাকে কে তুলে রাখবে। আর পুজোর সময় সেখান থেকেই ২০ টাকা দিয়ে আইসক্রিম খাবে ও বাকিটা রেখে দেবে সামলে। কারন এটাই সেই ছোট্ট মনের বিশাল রকমের সংরক্ষণ!
ছোটরা যে বড়দের দেখেই শেখে, তা আমরা জানি। তাই সব পাঠকদের উদ্দ্যেশ্যে বলব, ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ নিতে। যেমন— ঘর থেকে বেরবার সময় ঘরের লাইট, পাখা বন্ধ করে বিদ্যুৎ সঞ্চয় করা; জল সঞ্চয় করে ছোটদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, ছাদে কিংবা উঠোনে ছোট্ট পাত্রে পাখিদের জন্য জল রেখে দেওয়া, অহেতুক কাগজ নষ্ট না করা এবং প্লাস্টিক বর্জন করা, পারলে সৌরবিদ্যুতের ব্যাবহার শুরু করা। প্রকৃতি ও পরিবেশকে আরো সুন্দর গড়ে তোলার চেষ্টা চালাতে ছোটদের হাতে তুলে দেওয়া হোক পরিবেশ সচেতনতার সহজপাঠের বই। আসলে পরিবেশ সংরক্ষণ যে শুধু ক্যালেন্ডার দেখে ২৮ জুলাই ( বিশ্ব সংরক্ষণ দিবস) পালন করা যাবে তা নয়, সেটা পালিত হোক বাকি ৩৬৪ টা দিনও!
কারণ মানুষ যেদিন প্ৰথম পরিবেশ ধ্বংস করা শুরু করেছিল, সেদিনই সে নিজেরই মৃত্যুবাণ নির্মাণ করেছিল; আর আজ সারা পৃথিবী জুড়ে এই যে বিষ সৃষ্টি হচ্ছে, এও মানুষ জাতটাকে একদিন নিঃশেষে ধ্বংস করে ফেলবে–ব্ৰহ্মার ধ্যান-উদ্ভূত দৈত্যের মত সে স্ৰষ্টাকেও রেয়াৎ করবে না।
কারণ প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করবে না, কবি অনেক আগেই বলে গেছেন—
“যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।”
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( প্রশ্ন )
Wow, incredible weblog structure! How long have you ever been running a blog for?
you make running a blog glance easy. The overall look of your site
is fantastic, let alone the content! You can see similar here sklep online