Montage

ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও পরিবেশ সংরক্ষণ

ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও পরিবেশ সংরক্ষণ

ভূমিকা : পৃথিবীর জন্ম কীভাবে হয়েছিল তা আজও রহস্যাবৃত কিন্তু আমরা জানি যে এই পৃথিবী তে প্রাণী সৃষ্টি হওয়ার মত অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠতে বহু কোটি বছর লেগেছিল। তাই পরিবেশ ও প্রাণ যেন একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। সমস্ত প্রাণীই এই পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত। বিশেষ করে মানবজীবন। জন্মের পর মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে যায় মানবজীবনে পরিবেশের প্রভাব। আজ যে নবজাত , আগামী দিনে সে হয়ে উঠবে একজন পূর্ণ মানুষ। এই মানুষটি কেমন হবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে তার পরিবেশের ওপর। পরিবেশ বোঝাতে গিয়ে আমরা প্রাকৃতিক, সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক পরিবেশের কথা বলি। সুস্থ পরিবেশ যেমন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানবিক গুণে সমৃদ্ধ করে তেমনিই দূষিত পরিবেশ করে অমানুষ। ফরাসি দার্শনিক রুশো বলেছিলেন শিশু পবিত্র হয়েই জন্মায়, সামজিক পরিবেশ তাকে কলুষিত করে। পরিবেশ মানুষের ব্যক্তিত্ব, মানসিকতা ও মুল্যবোধের নিয়ন্ত্রক। তাই পরিবেশকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম-এর বিচার করা যায়না।

পারিবারিক পরিবেশের প্রভাব : ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঠামো শুরু হয় পারিবারিক পরিবেশ থেকে। শিশুর জীবনে প্রথম এবং অনিবার্য পরিবেশ তার পরিবারের পরিমন্ডল। ভালো মন্দের বোধশুন্য শিশু সবকিছু অনুকরণ করতে চায়। সুতরাং পরিবারের পরিবেশ যদি সুস্থ, সুন্দর ,রুচিশীল ও শঙ্খলাপূর্ণ হয় তাহলে শিশুটি সুন্দরভাবে বিকশিত হতে পারে। অস্বীকার করা যায় না যে ঠাকুর পরিবারের অসামান্য সাংস্কৃতিক পরিবেশ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ভবিষ্যৎ প্রজান্ম শিক্ষার দ্বারা সমাজমুখী হয়ে ওঠে। আদর্শ শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মধ্যে বপন করে মানবিক গুণাবলীর বীজ। শিক্ষায়তনের সহপাঠী ও সহপাঠিনীরা এবং শিক্ষক-শিক্ষীকারা সংশ্লিষ্ট শিক্ষায়তনের পরিবেশ গঠন করে। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য , উচ্চমূল্যবোধ প্রত্যেকটি ছাত্রছাত্রীর জীবনকে প্রভাবিত করে।

সামাজিক পরিবেশের প্রভাব : পারিবারিক পরিবেশের বাইরে রয়েছে বিশাল সমাজ পরিবেশ। সামাজিক পরিবেশে মানুষ প্রত্যক্ষ করে একদিকে আদর্শ অন্যদিকে আদর্শহীনতা , একদিকে নিঃস্বার্থ ত্যাগ অন্যদিকে লোভ। মানুষ বিভ্রান্ত হয়, যে যেমন ভাবে সামাজিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয় সে তেমনভাবেই সমাজে পরিচিত হয়। সুস্থ সামাজিক পরিবেশের প্রভাব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানব চরিত্রের উপর কল্যাণকর। তবে কিছু সমাজ বিরোধী, চোরাকারবারীদের প্রভাবের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অর্থাৎ তরুণদের সুকুমার বৃত্তিগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাবঃ
“ একটা পৃথিবী চাই
মায়ের আঁচলের মত
আর যেন ওই আঁচল জুড়ে
গান থাকে
যখন শিশুদের ঘুম পায়।“

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

কিন্তু কোথায় সেই পৃথিবী ? কোথায় সেই নীল আকাশ? যে প্রাকৃতিক পরিবেশে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে সেই পরিবেশ ক্রমশ বিনষ্ট ও জটীল হয়ে উঠছে। প্রকৃতিকে গ্রাস করছে বিজ্ঞান ও যন্ত্রসভ্যতা। প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষিত হয়ে আমাদের দৈহিক স্বাস্থের ক্ষতি করছে। ফলে বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে নানা জীবাণু, রোগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মে প্রেরিত হচ্ছে।পরিবেশ দূষণের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অর্থাৎ বর্তমান শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বায়ু দূষণের ফলে হৃদয় জড়িত বহু রোগ দেখা দিচ্ছে শিশুদের মধ্যে। শ্বাসকষ্টের সমস্যার জন্য অনেক শিশুরা মারা যাচ্ছে এবং শব্দ দূষণের ফলে শিশুদের শুনতে সমস্যা হচ্ছে। এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খুব সংকটময় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিকাশ একেবারেই বন্ধ।

রাজনীতিক পরিবেশের প্রভাবঃ রাজনৈতিক পরিবেশের থেকে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম একজন উপযুক্ত নাগরিক হতে শেখে। সে স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব, প্রজাতন্ত্রতা, গ্ণতন্ত্রতা এই কঠিন শব্দগুলির অর্থ বুঝতে শেখে। রাজনীতির মাধ্যমেই সে দেশের একজন আদর্শবান ব্যক্তি হয়ে ওঠে, দেশের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ হয়ে ওঠে। রাজনীতির অবশ্য কুদিক ও আছে। রাজনীতির ফলে অনেকেই অন্ধকার জগতে হারিয়ে যায়। দেশের আদর্শ নাগরিক হওয়ার বদলে সন্ত্রাসবাদী ও আসামী হয়ে ওঠে। বর্তমান মানুষ আজ মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। মানুষের ক্রমবর্ধমান লোভ প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করছে, অনৈতিক সামাজিক পরিবেশ বিনষ্ট করছে মানসিক স্বাস্থ্যকে , এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত জীবনের দিকে।

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রভাবঃ
“উত্থান তার শেষ নেই কোন , শেষ নেই দস্যুতার
যেখানে যতটুকু সবুজ রক্ত সবটুকু শুষে খাবে
নিঃসাড় করে দিয়ে যাবে সব সেগুন শিমুল শাল।“
– শঙ্খ ঘোষ
সভ্যতার অগ্রগতি এবং বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অগোচরে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যে সমস্যা একটু একটু করে ভয়াবহ জটিল হয়ে উঠছে তা হল পরিবেশ দূষণ। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির অহংকারের ফলে পরিবেশ দূষন ক্রমে বেড়েই চলেছে। পরিবেশ দূষনের ফলে বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন ঘটে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বের পক্ষে বিপদজনক। মানুষ নিজেই নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্ষতি করছে। দঃখের বিষয় এই যে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে বন সংরক্ষণ , বন সৃজন, পরিবেশ রক্ষা প্রভৃতি কথা সমাজের সর্বস্তরে বলে আসা হচ্ছে। পরিবেশ দূষন কমাতে মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। আজ যদি আমরা পরিবেশ ক্রমশ বিষিয়ে তুলি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কি হবে? হরপ্পা সভ্যতার কুশীলবদের মত আমাদেরও আগামী প্রজন্মের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

পরিবেশ সংরক্ষণঃ পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব দেশের প্রতিটি মানুষের ,নেতা থেকে সাধারণ মানুষ সকলেরই। কিন্তু দঃখের বিষয় যে জননেতাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি তারাই পরিবেশ নষ্ট করেন। নানা সরকারি আইন এই সমস্যা দূরীকরণে যথেষ্ট নয়। এইসব আইন মান্য করার মানসিকতা প্রয়োজন। এ ব্যপারে এগিয়ে আসতে হবে ছাত্রছাত্রীদের। আজকের ছাত্রছাত্রীরা ভবিষ্যৎ নাগরিক। বিদ্যালয়ে এবং কলেজে পরিবেশ সম্পর্কে যে পাঠদান করা হয় তা যেন কেবল বইয়ের পাতায় বন্দী হয়ে না থাকে। পরিবেশ রক্ষার উপায়গুলি দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। গৃহের ও বিদ্যালয়ের পরিবেশ রক্ষা করে এই মহৎ কাজের সূচনা করতে হবে। পরিবেশ রক্ষার গুরু দায়িত্ব আমরা এড়িয়ে গেলে আমাদের পরবর্তী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কবিগুরুর ভাষায় প্রশ্ন করবে,-
“ যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?”
– (প্রশ্ন)

পরিবেশ ও অরণ্যের সম্পর্কঃ পরিবেশ থেকেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অনুপ্রেরিত হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পরিবেশে থাকা অরণ্যের থেকে অনুপ্রেরণা পায়। অরণ্য মানেই তো এক প্রকৃত বন্ধুর প্রতিনিয়ত বন্ধুত্ব পালনের দৃষ্টান্ত। ভবিষ্যতের নাগরিকদেরও বন্ধুত্ব পালন শেখা অতি প্রয়োজন।
“মাটির কঠিন বাধা হল ক্ষীণ, দিকে দিকে হল দীর্ণ
নব অঙ্কূর জয়পতাকায় ধরাতল সমীকর্ণ।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (নীল অঞ্জনঘন)
দীর্ঘ গাছ যেন মাটির সন্তান হয়ে জ্যোতিস্কলোকে ঘোষনা করে পৃথিবীর জয়গান। কিন্তু বিনিময়ে কি পায় সে? শুধুই কুঠারঘাত। তবু মানুষের হিংসার বদলে সে বিলিয়ে দেয় ভালোবাসা। আজীবন শুধুই ত্যাগ, শুধুই সহিষ্ণুতা- অরণ্য যেন হয়ে ওঠে এক সবুজ সন্ন্যাসী। আগামী প্রজন্মকেও হতে হবে স্বার্থহীন, মানুষের কল্যাণ কর্মে এবং পরিবেশ সংরক্ষণ কর্মে নিজেকে নিযুক্ত করতে হবে।

উপসংহারঃ তাই মানুষের জীবনে পরিবেশের প্রভাব গভীর ও ব্যাপক। ক্ষুদ্র দলাদলি, স্বার্থচিন্তা, হিংসার মত্ততা,সাম্প্রদায়িক ধ্রর্মান্ধতা, রাজনৈতিক ধূর্তামি – এসব কিছু অসুস্থ পরিবেশের অনিবার্য পরিণাম। আবার পরিবশই এক অমিত শক্তির আধার। পরিবেশই সুস্থতার অঙ্গিকার, পরিবশই অসুস্থতার ফলশ্রুতি। পরিবেশই জীবনের জয়গান, পরিবেশ মৃত্যুর দূত। পরিবেশই উত্থান, পরিবেশই পতন। তাই পরিবার ও সমাজ পরিবেশ নিসর্গ পরিবেশের মতই সর্বদিক থেকে আদর্শ ও সুষম না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানব শিশুরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেনা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে আমাদের সকলকে পরিবেশ সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নিতে হবে। তাই আমদের প্রতিজ্ঞা কবির ভাষায় উচ্চারিত হোক –
“ এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।“
-সুকান্ত ভট্টাচার্য (ছাড়পত্র)

তথ্যসূচি – ১। ভাষা প্রসঙ্গ ( নবম-দশম শ্রেণী) ২। রচনা প্রবাহ ( অসীমা মহান্তি) ৩। গীতবিতান

0

Pratyusha pattanayak, DPS Howrah

I’m born and raised in Howrah. My strengths are my academic achievements as well as my capabilities of doing a work sincerely and responsibly. I wouldn’t like to point out my weakness but I’d like to say scope for improvement that is I want to be more patient and control my anger. My goal is to become a WBCS officer and to achieve a platform from where people would know me be it in dance or art. My ethics is “I will never sacrifice morals and ethics for anyone or any win “.

View All Authors >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen + eight =

Supported by:

skgf
skgf

Editor's Picks

Archive

Select a month to view the archive.

Back to Top