পৃথিবীতে বিশ্বযুদ্ধ যেমন জলবিভাজিকা, করোনা অতিমারীও তেমন জলবিভাজিকা। করোনা- পূর্ব দুনিয়া ও করোনা- উত্তর দুনিয়া গুণগতভাবে ভিন্ন। বর্তমান সময় ও সমাজ এক ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। স্বভাবতই ছাত্রসমাজ তার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না।
‘সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব, আমরা ভাঙি কূল। ‘ বাঁধ ভেঙে দেওয়ার মন্ত্রে ছাত্রসমাজ আবহমানকাল থেকে দীক্ষিত। অন্যায়- অত্যাচার- শাসন- শোষণ- নিপীড়ণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের দেশে কালে- কালে ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং তাদের মদত দিয়েছে, প্রশ্রয় দিয়েছে শিক্ষক- সমাজ। বস্তুত শিক্ষক- সমাজের দর্শনকে বাস্তব ভিত্তি দিয়েছে ছাত্রসমাজ ফরাসী বিপ্লব থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই ধারা বহমান।
করোনা অতিমারী মানব সভ্যতার কাছে একটি- ‘ চ্যালেঞ্জ ‘ ছুঁড়ে দেয়- হয় গৃহবন্দী থাকো, নয়তো মরো। অতিমারীর অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতিতে গৃহবন্দী দশায় যখন বিদ্যাতনের দরজা রুদ্ধ; জ্ঞানচর্চার প্রদীপ যখন নিভন্ত, তখন ছাত্র- শিক্ষকের যুগ্মপ্রয়াসে শুরু হল প্রযুক্তি নির্ভর- আরো স্পষ্ট করে বললে ‘ ডিজিটাল ‘ প্রযুক্তি নির্ভর- পড়াশুনা। শিক্ষক সমাজের বিচক্ষণ নির্দেশনায় ও ছাত্র- সমাজের উদ্দামতায় অতিরে ধূলিসাৎ অতিমারীর অচলায়তন; জ্ঞানচর্চার নিভন্ত শিক্ষা হয়ে উঠলো বহ্নিমান, মহীয়ান।
তবে নূতনের দূত এই প্রযুক্তি- নির্ভর পড়াশুনার মাধ্যম যে কোনো নয়া প্রযুক্তির মতোই অবিমিশ্র ইতিবাচক দিকের সূচনা করে নি। ভারতবর্ষের বহু মানুষ দারিদ্র- সীমার নীচে বসবাস করে। সেই প্রান্তিক পরিবারগুলির কাছে ‘ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ তাদের পরিবারভুক্ত ছেলেমেয়েদের কাছে অনলাইন – মাধ্যম পড়াশুনা শুধুমাত্র বিলাসিতা নয়, এক নির্মম পরিহাস। ফ্রান্স এর রানী যেমন দাওয়াই বাতলেছিলেন ফ্রান্স এর মানুষ যখন রুটি কিনতে পারছে না, কেক কিনলেই পারে।
তেমনি ওই প্রান্তিক পরিবারের শিক্ষার্থীদের পক্ষে অনলাইন মাধ্যমের সুযোগ গ্রহণ করা শুধুমাত্র কঠিন নয়, অবাস্তব ও অসম্ভব।
আর্থিক বিভাজন ছাড়াও ‘ ডিজিটাল ডিভাইড’- এর পেছনে রয়েছে গ্রাম- শহরের ভেদ। আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে শহর যখন প্রতিদিন দীপাবলী উদযাপন করে তখন শহর থেকে একটু দূরে গ্রাম- মফঃস্বল থাকে তমিস্রাবৃত। এক্ষেত্রে শুধু আমাদের রাজ্যকেই দৃষ্টান্ত করলে চলবে না; আসমুদ্রহিমাচল ব্যাপী ভারতবর্ষে এটাই বাস্তব।শহর থেকে দূরে ইন্টারনেট সংযোগ এক অলীক কল্পনা মাত্র। অর্থাৎ, ধনী- দরিদ্র, গ্রাম- শহর এই
‘ ডিজিটাল ডিভাইড ‘- কে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে।
আত্মদীপ হওয়ার লক্ষে ছাত্রসমাজ চিরকাল ব্রতী থেকেছে।জীবন- মৃত্যুকে তারা চিরকাল ‘ পায়ের ভৃত্য’ বলে পরিগণিত করে এসেছে। অতিমারী আবহে যখন সমাজ হতাশ, হতোদ্যম, বাক্যহারা তখন ছাত্রসমাজ নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ছুটে গেছে প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্ঝায় সর্বস্ব খুইয়ে যারা সর্বহারা হয়েছে তাদের পাশে। নিজেদের সীমিত সাধ্য অনুসারে প্রান্তিক পরিবারভুক্ত ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বাড়িয়ে দিয়েছে সহমর্মিতার হাত, নির্ভরতার আশ্বাস। শুধুমাত্র অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি-ই নয় সমগ্র সমাজের কাছে ছাত্রসমাজ হয়ে উঠেছে ভরসাস্থল। যুগান্তের কবির মতো তারা মর্যাদা দিয়েছে মানহারা মানুষগুলিকে।
যান্ত্রিক নাগরিক সভ্যতার প্রতি তীব্র ঘৃনায় কবি বলেছিলেন , ” দাও ফিরে সে অরণ্য , লও এ নগর ,” কিন্তু কবির আকুতিকে তোয়াক্কা না করে মানুষ নির্বিচারে নিধন করেছে অরণ্যকে। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য অতি সম্প্রতি ধ্বংস হয়েছে আমাজনের বৃষ্টি-বিধৌত নিবিড় অরণ্য। আর তারপরেই দেখা দিয়েছে কোভিড অতিমারী। এই দুইয়ের মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্ক আছে কিনা তা বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণের বিষয় । তবে সংবেদনশীল ছাত্রসমাজ হৃদয়ের সংবেদনশীলতায় অনুভব করেছে বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষসংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা।
যে বৃক্ষ দু’ বাহু বাড়িয়ে আকাশের আস্পৃহাকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে আনে অথচ সেই নীরব ও নির্নিমেষ উপকারী বন্ধু বৃক্ষকে মানুষ নিধন করেছে, অবহেলা করেছে নির্বিচারে, সেই বৃক্ষরাজির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করার চেষ্টায় ও বৃক্ষরোপণের প্রয়াসে ব্রতী হয়েছে ছাত্রসমাজ। প্রাণপণে পৃথিবীর জঞ্জাল সরিয়ে এ পৃথিবীকে নবজাতকের বাসযোগ্য করে তোলার দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে ছাত্রসমাজ।
ছাত্রসমাজ যুগে-যুগে, দেশে-দেশে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ঘোচাতে সংগ্রামরত থেকেছে। কারণ তাদের হৃদয় অনির্বাণ, পাবকশিখার মতো জাজ্বল্যমান; তাদের শিক্ষার্থীর পরিচয়ে ভেদ নেই ধনী-নির্ধনের স্বদেশ- পৰদেশের । এই পরিচয়ের নিদর্শন পাওয়া যায় যখন ছাত্রসমাজ নিজেদের সামান্য পুঁজিকে সম্বল করে প্রান্তিক ছাত্র- ছাত্রীদের হাতে তুলে দেয় দূরশিক্ষার মাধ্যম স্বরূপ এন্ড্রোয়েড ফোন। সেই দেন ও গ্রহণের মধ্যে নেই দাতার অভিমান বা গ্রহীতার অপমান। কারণ এতো নিজেকেই নিজে সাহায্য করে সামুদায়িকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার , সাথী হয়ে ওঠার এই মহৎ প্রক্রিয়া।
বর্তমান নাগরিক সমাজে বহু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নানা কারণে , নানা প্রয়োজনে একাকী জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। করোনা অতিমারীর আবহে তাঁরা খুব স্বাভাবিকভাবেই অসহায় বোধ করতে থাকেন। কে তাঁদের কাছে পৌঁছে দেবে জীবনদায়ী ওষুধ, কে পৌঁছে দেবে ক্ষুধার অন্ন ? এই সব প্রশ্নে যখন তাঁরা জেরবার , তখন দেবদূতের মতো তাঁদের প্রয়োজনীয় সম্ভার তাঁদের ঘরে পৌঁছে দিয়েছে ছাত্রসমাজ। ছাত্রসমাজ তাদের নিরালস কাজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করেছে মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।
কিছুদিন আগেই শহর ও শহরতলির মানুষ যখন কোভিড আক্রান্ত হয়ে দিশাহারা বোধ করছিলেন, অক্সিজেন সিলিন্ডার হাসপাতালের শয্যার সন্ধানে মরিয়া হয়ে পথে পথে ঘুরছিলেন, তখন ছাত্রসমাজ সামাজিক মাধ্যমে এক নতুন দিশা দেখালো। কোথায় অক্সিজেন পাওয়া যাবে, কোন হাসপাতালে মিলবে আরোগ্যের সন্ধান — ছাত্রসমাজ সেই দিকদর্শনে আলোকবর্তিকার মতো কাজ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , আমাদের প্রিয় শ্রী শিক্ষায়তন স্কুলের ও কলেজের কয়েকজন ছাত্রী এইসব কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্রসমাজ শুধু সমাজের দ্বারা লালিতই হয়নি, অতিমারিজনিত সংকটকালে সমগ্র সমাজকে, বিপন্ন মানুষকে অন্ন, প্রাণ, বায়ু দিয়ে লালন করেও দেখালো অরুণপ্রাতের তরুণদলের আত্মদানের অভিজ্ঞান।
ক্যাষ্ট্রসমাজ আলোর পথযাত্রী। অতিমারীর আঁধার তাদের গতিপথ রুদ্ধ করতে পারেনি ও পারবেনা। এই প্রত্যয়ে স্থিত হয়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্র- ছাত্রী তাদের প্রিয় শিক্ষক- শিক্ষিকার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা করে চলেছে। কোরোনার কোরাল গ্রাসের ভয়ে ভীত হয়ে যখন আত্মীয়- স্বজন করোনা রোগীর সংস্রব থেকে নিজেদের শতযোজন দূরে নিক্ষিপ্ত করেছে তখন এই ছাত্র- ছাত্রীরা মুমূর্ষু রোগীদের
দিয়েছে চিকিৎসা, বাঁচার আশ্বাস। নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে তারা রোগীদের কাছে হয়ে উঠেছে নির্ভয়- নির্ভর- নির্জন- স্বজন।
বিভিন্ন এলাকায় করোনা রোগীকে সমাজ যখন অচ্ছুৎ করে রেখেছে, তখন নিবিড় ঘন আঁধারের মাঝে আশার কিরণ নিয়ে এসেছে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছাত্র- ছাত্রী। সেই সকল মৃত্যুঞ্জয়ী ছাত্র- ছাত্রীরা রোগীদের ও রোগীর পরিবারের মানুষদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে খাদ্য, পথ্য, ওষুধ, ইনজেকশন ও প্রাণদায়ী সরঞ্জাম। নিজের বিপদকে অবহেলা করেও তারা মুমূর্ষু মান্যুষগুলির কাছে পৌঁছে দিয়েছে আরোগ্যের স্পর্শ, আশার কিরণ। তাদের কাছে ছাত্রসমাজ হয়ে উঠেছে অধনের ধন, অনাথের নাথ, অবলের বল।