Montage

ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও পরিবেশ সংরক্ষণ

ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও পরিবেশ সংরক্ষণ

• প্রাক্ কথন:”Nature leads us like-wise our fond mother “
-(H.W.Longfellow)
পরিবেশ আমাদের দ্বিতীয় জননী। পরিবেশ থেকেই মানুষ পায় বেঁচে থাকার রসদ ।পরিবেশের সাথে জীবের সম্পর্ক নিবিড়, অবিচ্ছেদ্য এবং অপরিমেয়। আদিম পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের স্পন্দন জেগেছিল উদ্ভিদ থেকেই। অন্ধ ভূমিগর্ভ থেকে উদ্ভিদই প্রথম শুনেছিল সূর্যের আহ্বান। প্রাণের বিজয় কেতন উড়িয়ে দিয়েছিল নিশ্চেতনগ্রহপিন্ডেরবুকে।সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে সবুজ উদ্ভিদ পরিবেশকে রক্ষা করে চলেছে নানা প্রতিবন্ধকতা থেকে।কবিরভাষায়-
“ গাছগুলো তুলে আনো বাগানে বসাও, আমার দরকার শুধু গাছ দেখাগাছ দেখে যাওয়াগাছের সবুজ টুকু শরীরে দরকার,আরোগ্যেরজন্যওইসবুজেরভীষণদরকার।“
-(শক্তিচট্টোপাধ্যায়)
কিন্তুকৃতঘ্ন মানুষ যান্ত্রিক সভ্যতায় এসে হাজার হাজার বছরের অগ্রগতির সঙ্গী এই সবুজ উদ্ভিদের অবদানকে অস্বীকার করছে- ফলে মাত্রাতিরিক্ত বৃক্ষচ্ছেদনের দরুণ সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। অবশেষে ভুক্তভোগী মানুষ সচেষ্ট হচ্ছে পরিবেশ দূষণ রোধে ।
আর এই পরিবেশ রক্ষায় মানব সভ্যতার প্রধান হাতিয়ার- ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

• পরিবেশেরবর্তমানঅবস্থা-পরিবেশ দূষণ:
পরিবেশের মধ্যে অবাঞ্ছিত পদার্থের মাত্রাতিরিক্ত অনুপ্রবেশের ফলে বর্তমানে সৃষ্টি হয়েছে পরিবেশ দূষণ। মাত্রাতিরিক্ত বৃক্ষচ্ছেদন ,অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার, অতিরিক্ত যানবাহনের ব্যবহারে উৎপন্নদূষিতগ্যাস, দূষিতগন্ধওরোগ-জীবাণুর আঁতুড়ঘর-আবর্জনার স্তুপ ,মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ, মানুষেরঅজ্ঞতা,অসচেতনতা ও অতিরিক্ত মুনাফার লোভের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যআজবিঘ্নিত।রোগ-জরাআজমানুষেরনিত্যসঙ্গী, প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষিত প্রায়, জীব-বৈচিত্র আজ বিলুপ্তির পথে, প্রতিনিয়ত চলছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তান্ডব লীলা। এই বিপদ মোকাবিলার জন্য আমাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন সাহস ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান, তেজোদ্দীপ্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
“মরুবিজয়ের কেতন ওড়াও শূণ্যেহে প্রবল প্রাণধূলিরেধন্য করো।“
-( বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

• পরিবেশসংরক্ষণেরপ্রয়োজনীয়তা:
পরিবেশ দূষণের প্রতিক্রিয়া যে কত মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে তা বোঝা যাবে নীচের পরিসংখ্যান থেকে।১৯৩২সালেবৃটেনের নিকেল কারখানায়,১৯৩৭সালে ওয়েলসের নিকেল কারখানায় শতাধিক কর্মীরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলো।১৯৫২সালে লন্ডনে প্রচুর লোকের মৃত্যু হয় ধোঁয়াশা জনিত রোগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে কেবলমাত্র বায়ু দূষণের জন্য প্রতিবছর প্রায় সত্তর লাখ লোকের মৃত্যু হয় পৃথিবীতে। বিশেষজ্ঞদের মতে বায়ুদূষণ এইহারে চলতে থাকলে২০৩০এরপরেআমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য কৃত্রিম অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হবে সুস্থভাবে বাঁচার জন্য। প্রাকৃতিক পরিবেশে বাসোপযোগী প্রাকৃতিক ভারসাম্য যদি ক্ষুণ্ণ হয়ে যায় তবে মানুষের বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়ে। দূষণের ফলে বর্তমান পৃথিবীতে যেভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীতে মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়বে। দূষিত পরিবেশ এর মধ্যে শিশুর জন্ম হবে পঙ্গু ও ব্যাধিগ্রস্ত অবস্থায়, যারা বেঁচে থাকবে তারা হবে অকালবৃদ্ধ। পরিবেশ দূষণের অভিশাপ মানুষের সমস্ত কর্মশক্তি ও যৌবন শক্তিকে নিঃশেষে শুষে নেবে। শহরওগ্রামাঞ্চলের আকাশ-বাতাসআজ কলকারখানারওযানবাহনেরকালো ধোঁয়ায়বিষজর্জর হয়ে থাকছে।দূষণচারিদিকে পেতে রেখেছে মৃত্যুফাঁদ।
তাই দ্রুত পরিবেশ সংরক্ষণে সচেষ্ট না হলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের সামনে অপেক্ষা করে আছে মহাবিপদ।

• পরিবেশসংরক্ষণেছাত্রসমাজতথাভবিষ্যৎপ্রজন্ম:
“Let nature be your teacher”
-(উইলিয়ামওয়ার্ডসওয়ার্থ)
পরিবেশে আমাদের প্রকৃত শিক্ষক। মানবসমাজ প্রকৃতির কাছ থেকে শেখে উদারতা, সহিষ্ণুতা, কঠোরতা, কর্মচঞ্চলতা প্রভৃতি জীবনের নানাদিক ,প্রয়োজনীয় বিষয়।
“ বিশ্ব প্রাণের স্পন্দন লাগতে দাও ছেলেদের দেহে মনে ,শহুরে বোবা-কালা মরা দেয়ালগুলোর বাইরে।“
-( বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
অশ্বমেধের ঘোড়া, অগ্রগতির চারণদল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আত্মত্যাগের মহিমায়,আদর্শেরনিষ্ঠায়, দায়িত্ব পালনে ও কর্তব্যেপ্রবলপ্রত্যয়ী। তাই তারাই পারে যন্ত্রদানবের চাপেন্যুব্জএই পরিবেশকে সোজা ভাবে দাঁড়করাতে, জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণে সচেষ্ট হতে।মনোবিজ্ঞান বলছে,ভবিষ্যৎ প্রজন্মযে দায়িত্ব নেয়, তার জন্য যে কোনোও মূল্য দিতে তারা প্রস্তুত থাকে।কর্তব্যকে তারা হাত দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে গ্রহন করে।
ভারতীয় সংবিধানের৫১(ক) ধারায় ভারতীয় নাগরিকদের ভারতীয় পরিবেশ রক্ষার কথা বলা হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ছাত্রসমাজরাও ভারতীয় নাগরিক হিসেবে সেই দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ। পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সচেতনতাই পারে যেকোনো উন্নয়নকে গতিশীল করতে।সেই উন্নয়নে ভবিষ্যৎ প্রজন্মই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করবে। সে জন্য যা করতে হবে তা হলো-
(ক) পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্বন্ধে নিজেদের সচেতন হওয়া।
(খ)জন স্বাস্থ্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে, সে বিষয়ে প্রচার করা।
(গ) সবরকম দূষণ ও তার কারণ সম্বন্ধে পারস্পরিক আলোচনা করে’ যথাসম্ভব তা বন্ধ করার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ।
(ঘ) নিজেদের পয়ঃ প্রণালী উন্নত করা।
(ঙ) যেসব কারণে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বিঘ্নিত হয় সেসব কাজ না করা।আহার-নিদ্রা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সচেতন হওয়া। সুষম খাদ্য সম্বন্ধে চেতনা গড়ে তোলা।
(চ) অবৈজ্ঞানিক মানসিকতা ও কুসংস্কার দূরীকরণে সচেষ্ট হওয়া।
(ছ) ঘর গৃহস্থালীর ও আশেপাশের পরিবেশের বর্জ্য পদার্থ নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলা।
(জ) হাসপাতাল, নার্সিং হোম, স্কুল ,কলেজ, রাস্তাঘাট, পার্ক, বাস, ট্রাম, ট্রেন, প্রভৃতি জায়গা সবসময় পরিচ্ছন্ন রাখা।
(ঝ) ধূমপান, মদ্যপান, ড্রাগ সেবনপ্রভৃতিথেকে বিরত থাকা।
(ঞ) বাড়ির সংলগ্ন পরিবেশের পক্ষে উপযোগী গাছ লাগানো ও পুরনো গাছ না কাটা।
(ট) গাছ আমাদের বন্ধু এই তথ্য সকলকে জানানো।
(ঠ) নানা জায়গায় পরিবেশ বিষয়ক আলোচনা করে ফ্ল্যাগ, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড প্রভৃতির দ্বারা পরিবেশ সম্বন্ধীয় প্রচারে সচেষ্ট হওয়া।
(ড) শক্তি সম্পদের অপব্যবহার ও অতি ব্যবহার না করা। আলো,পাখা, বিভিন্ন বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের পরিমিত ও প্রয়োজনানুসারে ব্যবহার করা।

• পরিবেশসংরক্ষণআন্দোলনেভবিষ্যৎপ্রজন্মেরভূমিকা:
পরিবেশ সংরক্ষণের লড়াইয়ে অন্যতম মুখ ১৮ বছর বয়সী সুইডিশ কন্যা গ্রেটা থুনবার্গ। বড়দের নির্বুদ্ধিতায় বিষিয়েযাচ্ছে পৃথিবী। প্রতি শুক্রবার স্কুলে না গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ‘ফ্রাইডেস ফর ফিউচার’ নামে পৃথিবীব্যাপী পরিবেশ সচেতনতামূলক কর্মসূচি শুরু করেছিলমধ্যকৈশোরেগ্রেটা। ওই বয়সেই সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন বিশ্বের তাবড় ধনকুবেরদের। বর্তমানে অষ্টাদশী গ্রেটা অভিনব ভাবনায় স্কুলের সহপাঠীদের নিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। গ্রেটা থুনবার্গকেই এবার নোবেল শান্তিপুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে।
গ্রেটার পাশাপাশি তালিকায় রয়েছেন রাশিয়ার প্রতিবাদী মুখ আলেক্সিনাভালনি ; এছাড়াওইতালিরডেভিডউইকার, নেদারল্যান্ডেরলিলিপ্ল্যাট,আয়ারল্যান্ডেরসাওয়িওকোন্নর,বেলজিয়ামেরআনুনাদিউইভার, আর্জেন্টিনারইয়েলউইনট্রাব,উগান্ডারলিহ্নামুগেরওয়া, জার্মানিরলুইসানিউবায়ার,ভারতেরজনপলজোস, আমেরিকারকাল্লানবেনসন,বাস্তিদা,ভিকব্যারেট,ইসরাহিরসি,মার্টিনেজ,জেমিমারগোলিন,আলেকজান্দ্রিয়াভিল্লেসেনরপ্রভৃতিরাহলেন পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যাক-১৬ ই অক্টোবর২০২০ বিশ্বের সবচেয়ে কনিষ্ঠতম পরিবেশ রক্ষা কর্মীনয়বছরবয়সীলিসিপ্রিয়াকাঙ্গুজাম একাই ভারতের দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনেনীরবে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তার দাবি ছিল একটাই পরিষ্কার ও স্বচ্ছ বাতাসে শ্বাস নিতে চায় সে। তার হাতের প্ল্যাকার্ড জানান দিচ্ছিল যে বিশ্বজুড়ে পরিবেশ দূষণের জন্য ৬০ লাখ শিশু মারা গিয়েছে।

• শেষ কথা:
“প্রাণ চাই ,আলো চাই ,চাই মুক্ত বায়ু
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু”
-( বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
প্রকৃতির ক্ষেত্রে অন্যান্য জীবের তুলনায় মানুষের পার্থক্য হলো মানুষ প্রকৃতির নিয়ম গুলি কে জানতে পারে এবং সঠিকভাবে এই নিয়মগুলিকে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু সমস্যা বা সংকট তখনই সৃষ্টি হয়, যখন সভ্যতার পরিবর্তন ঘটাতে গিয়ে মানুষ প্রকৃতি জগতের নিয়মগুলিকে অস্বীকার করে বসে।
সভ্যতার অগ্রগতি থামিয়ে দূষণ রোধ করা সম্ভব নয়। বৃন্তচ্যুত ফল যেরকম পুনরায় বৃক্ষ শাখায় ফিরে যাবে না, তেমনি পরিবেশ দূষণের ফলেযা ধ্বংস হয়েছে তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ভবিষ্যৎ পৃথিবী আরো যেন নতুন করে দূষণ ক্লিষ্ট না হয়ে পড়ে সে ব্যাপারে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যেতে পারে। এজন্য অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে নবচেতনা,নবউন্মেষের অগ্রদূত ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেই।
“পরিবেশ অবক্ষয় ঘটছে দুনিয়া জুড়ে, বাড়ছে বিপদের আশঙ্কা ;…কিন্তু সমস্যা থেকেই জন্ম নেয় উন্নত প্রযুক্তি। তাই দূষণ রোধের বিজ্ঞান আজ আমাদের করায়ত্ত।অবক্ষয়ই শেষ কথা নয় প্রতিরোধই শেষ কথা।“
-(ডাঃসন্তোষকুমারঘোড়ই,পদার্থবিদ্যাঅধ্যাপক)
মানব সভ্যতা তার জন্মের ঊষালগ্ন থেকে যার হাত ধরে ধীর পদক্ষেপে গৌরবোজ্জ্বল আলোর দিকে এগিয়ে গেছে, সে হলো পরিবেশ। আজকের বিজ্ঞানের যুগেও এই পরিবেশ এর উপযোগিতা অস্বীকার করা যায় না। তাই এই পরিবেশ সংরক্ষণে ভবিষ্যৎপ্রজন্মকে এগিয়ে আসতেই হবে-কবিরকথা শুনতেই হবে।
“আর্তধরারপ্রার্থনাএইশোনো,
শ্যামবনবীথিপাখিদেরগীতি
সার্থকহোকপুনঃ।“
-( বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

0

Aditri Tarafdar, Vidyasagar Shishu Niketan, Midnapore.

Though I study in an English medium school, writing in Bengali has always attracted me. I love to dance and recite. I have a keen interest in travelling to different destinations and getting to know about various people. In future I want to associate myself with that profession through which I can help the society.

View All Authors >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × 1 =

Supported by:

skgf
skgf

Editor's Picks

Archive

Select a month to view the archive.

Back to Top